চট্টগ্রামের বিভিন্ন আসনে ভোটকেন্দ্রে প্রদত্ত ভোটের এ রকম আকাশ–পাতাল ফারাক দেখা গেছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম–৫ (হাটহাজারী–আংশিক শহর) আসনের বায়েজিদ বোস্তামী ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড উচ্চবিদ্যালয় (নিচতলা) কেন্দ্রে মোট ভোটার ৭৪০টি। ভোট পড়েছে মাত্র ৮টি। তার মধ্যে আবার একটা বাতিল। প্রদত্ত ভোটের হার ১ শতাংশ মাত্র। আবার একই আসনের উত্তর ছাদেক নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৮০ শতাংশ। আসনটির ১৪৬ কেন্দ্রে গড় ভোটের হার ২০ দশমিক ৮৫।
আবার চট্টগ্রাম–২ (ফটিকছড়ি) আসনে মজহারুল উলুম গাউছিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে গড়ে ৯৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। ৪ হাজার ৯৪ ভোটের মধ্যে ৪ হাজার ১৫ ভোট পড়েছে এখানে। এর মধ্যে ১ হাজার ৭৮ ভোট বাতিল করা হয়। জাল ভোট এবং স্বাক্ষর না থাকায় ব্যালট বাতিল করা হয় বলে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. আসাদুল্লাহ খালিদ জানান। আবার এখানে ১০ থেকে ১৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ৯ কেন্দ্রে। ১৪২ কেন্দ্রে গড়ে ৩৩ শতাংশ ভোট পড়ে।
এই নির্বাচনে সবকিছু নির্ধারিত ছিল। অংশগ্রহণমূলক ছিল না। তাই কোথাও কেউ ১ শতাংশ পেয়েছে, আবার কেউ শতভাগ মেরে নিয়েছে। নির্বাচনে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি।সুজন চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী
চট্টগ্রামের বিভিন্ন আসনে ভোটকেন্দ্রে প্রদত্ত ভোটের এ রকম আকাশ–পাতাল ফারাক দেখা যাচ্ছে। কিছু কেন্দ্রে অস্বাভাবিক বেশি ভোট পড়েছে। আবার কিছু কিছু কেন্দ্রে একেবারে কম ভোট পড়েছে। অস্বাভাবিক বেশি ভোট পড়া কেন্দ্রগুলোতে কারচুপি, জাল ভোটসহ প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ করেছেন পরাজিত প্রার্থীরা। নির্বাচন কমিশনের কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণে এসব তথ্য জানা গেছে।
চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের মধ্যে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে চট্টগ্রাম–১১ (বন্দর পতেঙ্গা) আসনে—২০ দশমিক ৪৫ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি পড়েছে চট্টগ্রাম–৬ (রাউজান) আসনে—৭৩ শতাংশের বেশি। এরপর রয়েছে চট্টগ্রাম–৭ (রাঙ্গুনিয়া), ভোট পড়েছে ৬৯ শতাংশের বেশি। রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম–৯ (কোতোয়ালি–বাকলিয়া), চট্টগ্রাম–১৩ আনোয়ারা, চট্টগ্রাম–৪ সীতাকুণ্ড আসনে আওয়ামী লীগ–দলীয় প্রার্থীর সঙ্গে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। তারপরও এসব আসনে তুলনামূলক ভোট বেশি পড়েছে।
অন্যদিকে হাটহাজারী আসনেও ৪টি কেন্দ্রের কোনোটিতে ১০০ ভোটও পড়েনি। বায়েজিদ বোস্তামী ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড উচ্চবিদ্যালয় (নিচতলা) ছাড়াও একই ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার কেন্দ্রটিতে ২ শতাংশ হারে ৬২ ভোট পড়ে মাত্র।
বন্দর পতেঙ্গা আসনে সর্বোচ্চ গড়ে ভোট পড়েছে নিশ্চিন্তাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে—৪৮ শতাংশ। এখানে ৯৭১ ভোট
পায় নৌকা প্রতীক। নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী কেটলি ৫৪৩ ভোট পায়।
একই আসনের তিনটি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ১০০–এর কম। হালিশহর আহমদ মিয়া সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের দুটি কেন্দ্রে যথাক্রমে ৮৭ ও ৯৬ ভোট পড়ে। হার যথাক্রমে প্রায় ৩ ও ৪ শতাংশ। এ ছাড়া আশরাফুল ঊলুম মুহিবুল্লাহ বালক-বালিকা মাদ্রাসা কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৩ শতাংশ হারে—৮৭টি।
অন্যদিকে হাটহাজারী আসনেও ৪টি কেন্দ্রের কোনোটিতে ১০০ ভোটও পড়েনি। বায়েজিদ বোস্তামী ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড উচ্চবিদ্যালয় (নিচতলা) ছাড়াও একই ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার কেন্দ্রটিতে ২ শতাংশ হারে ৬২ ভোট পড়ে মাত্র। ব্রাইট সান কিন্ডারগার্টেন হাইস্কুলে ৩ শতাংশ হারে ৮০টি ভোট পড়ে। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রেও ভোট পড়েছে ৭২টি, হার ৩ শতাংশ।
চট্টগ্রাম–৩ (সন্দ্বীপ) আসনে মমতাজুল উলুম মাদ্রাসা নামে একটি কেন্দ্রে ১০০ শতাংশ ভোট দেখানো হয়। তবে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা গাজী আমিরুল ইসলাম দাবি করেছেন, অব্যবহৃত ব্যালট বাতিল ভোটে দেখানোর কারণে এমন অবস্থা হয়েছে।
আন্দরকিল্লা ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় কেন্দ্রটিতে ভোট পড়ে ৭০ শতাংশের বেশি। এই আসনে নৌকার প্রার্থী মহিবুল হাসান চৌধুরী জিতেছেন।
চট্টগ্রাম–১৩ (আনোয়ারা–কর্ণফুলী) আসনে গড়ে ভোট পড়েছে ৫৭ শতাংশ। এখানে নৌকা প্রতীক নিয়ে জিতেছেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী। হাইলধর বশিরুজ্জামান স্মৃতি শিক্ষাকেন্দ্রে ৮৭ শতাংশ ভোট পড়েছে। নৌকা ভোট পেয়েছে ৩ হাজার ১৭৮টি। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আবদুর রব চৌধুরী পান ১১ ভোট।
চট্টগ্রাম–১ মিরসরাই আসনে ৮৪ শতাংশ ভোট পড়েছে কয়লা শহীদ জাকির হোসেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। এখানে ১ হাজার ৬৫২ ভোট পায় নৌকা। ঈগল প্রতীক পায় ২১৩ ভোট। চারটিতে পড়ে ৬০ শতাংশের বেশি ভোট। আবার ৯টিতে পড়েছে ২০ শতাংশের কম। আসনটির গড় ভোট প্রায় ৪০ শতাংশ।
চট্টগ্রাম–৯ আসনে গড় ভোট ছিল ৩৪ শতাংশের বেশি। ১৪ কেন্দ্রে ২০ শতাংশের কম ভোট পড়ে। আবার ৬০ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে ১০টিতে। আন্দরকিল্লা ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় কেন্দ্রটিতে ভোট পড়ে ৭০ শতাংশের বেশি। এই আসনে নৌকার প্রার্থী মহিবুল হাসান চৌধুরী জিতেছেন।
চট্টগ্রাম–৮ আসনে গড়ে ২৭ শতাংশ ভোট পড়ে। ১৫ শতাংশের নিচে ছিল ১৯টি কেন্দ্র। ৪৫ থেকে ৬০ শতাংশের বেশি ছিল ১৮টিতে। এখানে আওয়ামী লীগের দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীর লড়াইয়ে আবদুচ ছালাম জিতেছেন।
চট্টগ্রাম–১৬ (বাঁশখালী) আসনে ৬০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে দুটি কেন্দ্রে। ২০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে ২০টি কেন্দ্রে। ২০ শতাংশের কম পড়েছে ৫টিতে।
চট্টগ্রাম–১৪ (চন্দনাইশ–সাতকানিয়া আংশিক) আসনে ১০০ কেন্দ্রে গড়ে ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে। এখানে জিতেছেন আওয়ামী লীগের নজরুল ইসলাম চৌধুরী। আসনটিতে ৪ কেন্দ্রে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। ২০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে ৫টি কেন্দ্রে।
চট্টগ্রাম–১২ (পটিয়া) আসনে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী সামশুল হক চৌধুরীকে হারিয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী জিতেছেন। ভোট পড়েছে ৫১ দশমিক ৫৪ শতাংশ হারে। এখানে ছয়টি কেন্দ্রে ভোট পড়ে ৮০ শতাংশের ওপর।
চট্টগ্রাম–১০ (পাহাড়তলী–ডবলমুরিং–খুলশী) আসনে গড়ে ২২ শতাংশ হারে ভোট পড়েছে। ৪০ শতাংশের বেশি পড়েছে ৯টিতে। ১০ শতাংশের কম ভোট ছিল ৭টি কেন্দ্রে। এখানে নৌকা প্রতীক নিয়ে মো. মহিউদ্দিন জিতেছেন।
ভোটের এ রকম পার্থক্যের কারণ জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই নির্বাচনে সবকিছু নির্ধারিত ছিল। অংশগ্রহণমূলক ছিল না। তাই কোথাও কেউ ১ শতাংশ পেয়েছে, আবার কেউ শতভাগ মেরে নিয়েছে। নির্বাচনে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি।’