শুরুতে আশা জাগিয়েছিল। এখন গ্রাহক, রাজস্ব, নেটওয়ার্কের আওতা—সব ক্ষেত্রে সবার চেয়ে অনেক পিছিয়ে। বছর বছর লোকসান।
২০০৫ সালে টেলিটক যখন বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে, তখন মানুষের আগ্রহের কোনো শেষ ছিল না। কারণ, সরকারি এই মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর কম খরচে কথা বলার সুযোগ দেওয়ার প্রত্যাশা জাগিয়েছিল।
তখনকার পত্রিকা ঘেঁটে দেখা যায়, টেলিটক প্রতি মিনিট কথা বলার মাশুল (কলচার্জ) ধার্য করেছিল ৪ টাকা, যা গ্রামীণফোনের ক্ষেত্রে ছিল ৬ টাকা। রাত ১০টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত কথা বলা যেত ২ টাকা ৬০ পয়সা দিয়ে। টেলিটকের প্রি–পেইড একটি সিমের দাম ছিল তিন হাজার টাকা। এটিও অন্য অপারেটরের চেয়ে বেশ কম ছিল।
ব্যয়সাশ্রয়ী হওয়ায় তখন মানুষ লাইন ধরে টেলিটকের সিম (গ্রাহক শনাক্তকরণ নম্বর) কিনেছিলেন। আজ ১৭ বছর পর টেলিটক চারটি অপারেটরের মধ্যে গ্রাহকসংখ্যা, রাজস্ব ও নেটওয়ার্কের আওতার দিক দিয়ে সবার পেছনে। প্রতিষ্ঠানটি বছর বছর লোকসান দিচ্ছে। বাড়ছে দায়দেনা।
মোটাদাগে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও অধ্যাপক রেহমান সোবহান দুটি কারণে সরকারি খাতে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রাখার কথা বলেছিলেন।জাহিদ হোসেন, বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ
টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেডের ওয়েবসাইটে গেলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের ছবিসহ একটি উদ্ধৃতি দেখা যায়। সেটি হলো, ‘টেলিটককে মানুষের প্রত্যাশার জায়গায় নিয়ে যেতে আমরা কাজ শুরু করেছি এবং সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন টেলিটক হবে মানুষের প্রথম পছন্দ।’
মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি মোবাইল অপারেটরের সফল হওয়ার পেছনে মূল বিষয় হলো বিনিয়োগ। বিনিয়োগ না হলে, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি না হলে কোনো প্রতিষ্ঠান দাঁড়াতে পারে না। টেলিটকে সরকারি যে বিনিয়োগ হওয়া প্রয়োজন, ছিল তা হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ২০১৮ সালে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর টেলিটকের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।
অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, টেলিটককে জাগিয়ে তোলা সম্ভব হবে কি না, সেই সংশয় রয়েই গেছে।
রাজধানীর নিকেতনের মতো এলাকার বাসিন্দা হয়েও তিনি নেটওয়ার্ক সমস্যায় পড়েন।মুশফেকা ইসলাম, ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
টেলিটক শতভাগ সরকার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর এটি যাত্রা শুরু করে। যদিও বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে ২০০৫ সালের ৩১ মার্চ। টেলিটকের ওয়েবসাইটে এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, দেশের প্রতিটি কোনায় প্রতিটি মানুষকে সবচেয়ে সাশ্রয়ী সেবা দেওয়া। সরকারের রাজস্বের নতুন উৎস হিসেবে কাজ করা এবং বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করাও টেলিটকের উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) গত অক্টোবর মাসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মুঠোফোনের সক্রিয় সিমসংখ্যা এখন ১৮ কোটির বেশি। গ্রামীণফোনের ৮ কোটি, রবির সাড়ে ৫ কোটি ও বাংলালিংকের প্রায় ৪ কোটি গ্রাহক থাকলেও টেলিটকের গ্রাহক ৬০ লাখ ৭৫ হাজার, যা মোট গ্রাহকের ৪ শতাংশের কম।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানে টেলিটকের সিম ব্যবহার বাধ্যতামূলক। আবার সরকারি কিছু সেবা নিতে টেলিটকের সিম থাকতে হয়। যেমন সরকারি চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে আবেদন। এসব কারণে অনেকে টেলিটকের সিম রাখেন।
তিনি সম্প্রতি এই পদে এসেছেন। টেলিটকের সমস্যাগুলোর কারণ খুঁজে তা থেকে কীভাবে বের হয়ে আসা যায়, তার জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করছেন।হাবিবুর রহমান, টেলিটকের লোকসান ও ব্যর্থতার কারণ জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক
প্রতিষ্ঠার পর ১৭ বছরেও টেলিটক দেশের বড় একটি অংশকে নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে পারেনি। কোম্পানিটি জানিয়েছে, দেশের ৬১ শতাংশ এলাকা টেলিটকের দ্বিতীয় প্রজন্মের (টু–জি) নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত। যেসব এলাকায় শুধু টু–জি নেটওয়ার্ক রয়েছে, সেখানে মানুষ ফোনে শুধু কথা বলা ও খুদে বার্তা পাঠাতে পারে। ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য দরকার হয় থ্রি–জি ও ফোর–জি নেটওয়ার্ক।
দেশের ৫০ শতাংশ এলাকা টেলিটকের থ্রি–জি ও ৩২ শতাংশ এলাকা ফোর–জির আওতাভুক্ত। কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত কিছু বড় শহরে টেলিটক দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা দিতে পেরেছে। অনেক শহরে সেটাও পারেনি। যেমন লক্ষ্মীপুর, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জে টেলিটকের ফোর–জি সেবা নেই। ঢাকার ২০ শতাংশ এলাকাও এই সেবার বাইরে। যদিও ফোর–জি সেবার ক্ষেত্রে বেসরকারি অপারেটরগুলো বহুদূর এগিয়ে গেছে।
নেটওয়ার্কের আওতা বাড়াতে দরকার বেজ ট্রান্সসিভার স্টেশন (বিটিএস), যা টাওয়ার নামে পরিচিত। টেলিটকের বিটিএস আছে ৫ হাজার ৬৬১টি। যেখানে গ্রামীণফোনের ১৮ হাজার এবং রবির সাড়ে ১৫ হাজার বিটিএস রয়েছে।
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুশফেকা ইসলাম ২০০৮ সাল থেকে টেলিটকের গ্রাহক। হতাশা প্রকাশ করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানীর নিকেতনের মতো এলাকার বাসিন্দা হয়েও তিনি নেটওয়ার্ক সমস্যায় পড়েন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন একটি নম্বর ব্যবহার করছেন। সেটা বদলাতেও পারছেন না।
টেলিটকের লোকসান ধারাবাহিক। ১৭ বছরে তারা মাত্র দুই অর্থবছরে মুনাফার মুখ দেখেছিল। টেলিটকের দেওয়া হিসাব বলছে, ২০২১–২২ অর্থবছরে সেবা বিক্রি করে তাদের আয় ৪৯৮ কোটি টাকা। কিন্তু পরিচালন ব্যয় এত বেশি যে নিট লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২৫ কোটি টাকার বেশি। বিগত তিন অর্থবছরের মধ্যে সর্বশেষ অর্থবছরে লোকসান বেশি হয়েছে।
গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টেলিটকের দেনা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ২১৭ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে সরকারের পাওনা প্রায় ২ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা। বিটিআরসির পাওনা আরও ১ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) বিদ্যুৎ বিল হিসেবে পায় ৩৮৯ কোটি টাকার বেশি। শুধু সরকার নয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছেও টেলিটকের দেনা রয়েছে। এর মধ্যে সরঞ্জাম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পায় ১৬৬ কোটি টাকা। ব্যাংক ও অন্য ঋণদাতারা পায় ১৯৪ কোটি টাকার মতো।
৫ হাজার ২১৭ কোটি টাকা দেনার বিপরীতে টেলিটকের পাওনা আছে ১৪১ কোটি টাকার মতো।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, টেলিটকের আর্থিক পরিসংখ্যান থেকে যা জানা যায়, তাতে মনে হয়, তাদের টিকে থাকার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটিতে সরকারি মূলধন, ঋণ, অনুদান রয়েছে এবং অব্যাহত লোকসানের কারণে তা শোধ করার পরিস্থিতিও নেই। এগুলো সরকারের দায় তৈরি করে।
বিটিআরসি পাওনা আদায় ও সেবার মান নিশ্চিতের ক্ষেত্রে অন্য অপারেটরদের ওপর যতটা কঠোর হয়, ঠিক ততটাই উদার থাকে টেলিটকের প্রতি। গত সেপ্টেম্বর মাসে কল ড্রপ ও ক্ষতিপূরণ নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করেছিল বিটিআরসি। সেখানে কোন অপারেটরের কল ড্রপের হার কত, তার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়। তবে টেলিটকের কোনো তথ্য সেখানে ছিল না।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার সেদিন বলেছিলেন, সরকারি এই অপারেটরদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি আছে। তাদের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য একটু সময় দেওয়া হচ্ছে।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) গত আগস্ট মাসে টেলিটকের নেটওয়ার্ক সক্ষমতা বাড়াতে ২ হাজার ২০৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়। এ প্রকল্পের মাধ্যমে টেলিটক ৫০০টি নতুন টাওয়ার বসাবে। পাশাপাশি অন্য অপারেটরদের সঙ্গে ভাগাভাগির মাধ্যমে আড়াই হাজার টাওয়ার বাড়াবে।
নতুন করে ৩ হাজার টাওয়ার যোগ হলেও অন্যদের চেয়ে পিছিয়েই থাকবে টেলিটক। কারণ, টেলিটকের টাওয়ার দাঁড়াবে সাড়ে ৯ হাজারের মতো। এখন গ্রামীণফোনের ১৮ হাজারের বেশি ও রবির ১৫ হাজারের বেশি টাওয়ার রয়েছে। সংখ্যা বাড়ছেও। অপারেটরগুলো আগামী এক–দুই বছরের মধ্যে ফাইভ–জি চালুর চিন্তা করছে। টেলিটক ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভ-জি পরীক্ষা চালিয়েছে। কয়েকটি জায়গায় এ সুবিধা চালু হয়েছিল। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ সুবিধা এখন বলার মতো অবস্থায় নেই।
রাজধানীতে টেলিটক ফাইভ-জি চালু করতে ২৩৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছিল। কিন্তু সরকার প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়নি, গত আগস্টে ফিরিয়ে দেয়।
টেলিটক কেন পারল না, তা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তা এবং টেলিযোগাযোগ খাতের বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেছেন, টেলিটকে লোকসানের জন্য জবাবদিহি নেই। লোকসান হলে কোম্পানি পরিচালনার সঙ্গে যুক্তদের কোনো ক্ষতি হয় না। পাশাপাশি টেলিটক সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, নজরদারি, পরিকল্পনার অভাবসহ নানা কারণে এটি সফল হতে পারেনি।
টেলিটকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান পদাধিকারবলে ডাক ও টেলিযোগাযোগসচিব। পরিচালনা পর্ষদে বাকি আট সদস্যের মধ্যে সাতজনই সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থায় কর্মরত। একজন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সহসভাপতি।
টেলিটকের লোকসান ও ব্যর্থতার কারণ জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, তিনি সম্প্রতি এই পদে এসেছেন। টেলিটকের সমস্যাগুলোর কারণ খুঁজে তা থেকে কীভাবে বের হয়ে আসা যায়, তার জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করছেন।
বাংলাদেশে সরকারের মালিকানাধীন বেশির ভাগ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান লোকসানি ও অদক্ষ। এসব সংস্থার প্রধানেরা যুক্তি তুলে ধরেন এই বলে যে বাজারে প্রতিযোগিতার স্বার্থে তাদের দরকার। আবার জরুরি পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে পুরোটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু বাজারে এলে তাদের তেমন কোনো প্রভাব থাকে না।
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও অধ্যাপক রেহমান সোবহান ১৯৮০ সালে একটি বই লিখেছিলেন, যার নাম ছিল পাবলিক এন্টারপ্রাইজ ইন অ্যান ইন্টারমিডিয়েট রিজিম: আ স্টাডি ইন দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অব বাংলাদেশ। বইটির বরাত দিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মোটাদাগে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও অধ্যাপক রেহমান সোবহান দুটি কারণে সরকারি খাতে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রাখার কথা বলেছিলেন।
এক. বৈষম্য কমানো। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফামুখী না হয়ে মানুষের কল্যাণের জন্য পণ্য ও সেবা বিক্রি করবে সাশ্রয়ী মূল্যে। দুই. বেসরকারি খাতে একচেটিয়া ব্যবসা করার প্রবণতা থাকে। সরকারি কোম্পানিগুলো দক্ষতার পরিচয় দিয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করবে।
জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে এর দুটির কোনোটাই দেখা যায়নি। অদক্ষ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনীতির কোনো উপকার করে না। বরং সরকারের বাজেটের বোঝা তৈরি করে। এগুলো টিকিয়ে রাখা হয় রাজনৈতিক অর্থনীতির কারণে। অদক্ষ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সুফলভোগী আমলারা। কারণ, তাঁরা এসব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে থাকেন।