১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিভাগীয় গণসমাবেশ সামনে রেখে পুলিশের ‘বিশেষ অভিযান’ চলছে বলে মনে করে বিএনপি। দলটি বলছে, তালিকা ধরে তাদের মাঠপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও সংগঠকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর ও আশপাশের জেলার নেতারা অভিযানের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। প্রায় প্রতি রাতে বিভিন্নজনের বাড়িঘরে অভিযান চালানো হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুসারে, বিশেষ অভিযানে গত সোমবার সকাল ৬টা থেকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানী ঢাকায় ২৮৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ নিয়ে গত তিন দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ১ হাজার ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য হচ্ছে, বিশেষ অভিযানের প্রথম পাঁচ দিনে (সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত) সারা দেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩ হাজার ৮৯৫ জনকে। সর্বশেষ সোমবার সকাল থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত সারা দেশে কতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সে তথ্য গতকাল দিতে পারেনি পুলিশ সদর দপ্তর।
তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর বলছে, বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তারের সব তথ্য তারা পায়নি। গতকাল পর্যন্ত তাদের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে তাদের ১ হাজার ৪০০ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদের বড় অংশই বিএনপির মাঠপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা-কর্মী।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, গ্রেপ্তার এড়াতে ঢাকা মহানগর ও আশপাশের জেলা–উপজেলার বিএনপি এবং এর অঙ্গ–সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অনেকে বাড়িতে থাকছেন না। ঢাকা মহানগর বিএনপির এমন পাঁচজন নেতার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁদের অভিযোগ, তাঁদের খোঁজে পুলিশ বাসায় যাচ্ছে। তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ভয় দেখাচ্ছে।
বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের সম্পর্কে সরকার যা-ই বলুক, মানুষ মনে করে, ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সম্মেলনকে বাধাগ্রস্ত করতে এই কথিত অভিযান চলছে।শাহদীন মালিক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক আহ্বায়ক হাফিজুর রহমান গতকাল টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চার–পাঁচ দিন ধরে আওয়ামী লীগের লোকজন নানাভাবে চাপ দিচ্ছেন। পুলিশ কয়েকবার বাসায় গেছে। তাই এলাকায় থাকতে পারছি না। আমার মতো অনেক নেতা-কর্মী বাসায় থাকতে পারছেন না।’
তবে পুলিশের ভাষ্য, ঢাকায় পুলিশ হেফাজত থেকে দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়া, মহান বিজয় দিবস, খ্রিষ্টানদের বড়দিন ও খ্রিষ্টীয় বর্ষবরণ উদ্যাপন নিরাপদ-নির্বিঘ্ন করতে ১ ডিসেম্বর থেকে সারা দেশে পুলিশের বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে। এটা চলবে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। পুলিশের দাবি, যাঁদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাঁরা নাশকতা, অস্ত্র, মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত।
পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) জিয়াউল আহসান তালুকদার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মাঝেমধ্যে বিশেষ অভিযান চালানো হয়। গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত ও মামলার আসামি ধরতে এমন অভিযানে বিশেষ নজর থাকে।
গণমাধ্যমকে বিএনপির দেওয়া তালিকা অনুযায়ী, ১ ডিসেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত ঢাকা মহানগরের গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ৪৫ নেতা-কর্মী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে মহানগর দক্ষিণের নিউমার্কেট থানা বিএনপির সহসভাপতি আরিফ মোল্লা, ওয়ারী থানার ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মুনির হোসেন, মহানগর পূর্ব ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. হাসান এবং মহানগর উত্তরের মিরপুরের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি মেজবাহ উদ্দিন, পল্লবী থানা বিএনপির সাবেক প্রচার সম্পাদক ফারুক হোসেন, দক্ষিণখানের ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান ও ভাটারার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আতিকুল ইসলাম অন্যতম। এ ছাড়া ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে বিএনপির সমাবেশ থেকে ফেরার পথে সাভারের আমিন বাজার থেকে যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিনসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, দলটির এমন অভিযোগের বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এ অভিযোগ তাঁর জানা নেই। পরোয়ানাভুক্ত ও মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করতে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে।
তবে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া এসব ব্যক্তি সম্পর্কে সরকার যা-ই বলুক, মানুষ মনে করে ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সম্মেলনকে বাধাগ্রস্ত করতে এ কথিত অভিযান চলছে। এ ধরনের অভিযানে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা আরও কমবে।
যেকোনো রাজনৈতিক সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিশেষ প্রস্তুতি নিতে হয়। বিএনপির সমাবেশের অবস্থা বুঝে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।মো. আসাদুজ্জামান, ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার
বিএনপির তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরের বাইরে ঢাকা জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে দলটির ২৬ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে। আশপাশের জেলার মধ্যে মুন্সিগঞ্জ থেকে জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল হাইসহ জেলার ১৬ নেতা-কর্মী, নারায়ণগঞ্জে জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি কাজী আরিফসহ ১৩ জন, নরসিংদী থেকে সাভার থানা বিএনপির সহসভাপতি সোহরাব হোসেনসহ ১১ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও নরসিংদী জেলার আহ্বায়ক খায়রুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, নেতা-কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে ঢাকার গণসমাবেশকে বাধাগ্রস্ত করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পুলিশকে ব্যবহার করছে। ‘গায়েবি’ মামলা করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে।
প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যানুযায়ী, বিশেষ অভিযান শুরুর পর নরসিংদীর সাতটি থানায় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ৪১৯ নেতা–কর্মীর নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৯৪০ নেতা–কর্মীকে আসামি করে ১৬টি নতুন মামলা করেছে পুলিশ। এই জেলায় গত পাঁচ দিনে বিএনপির ৬৭ জন নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ফাইজুর রহমান, শহর শাখার সাধারণ সম্পাদক ফারুক উদ্দিন ভূঁইয়া, শহর যুবদলের আহ্বায়ক মাহমুদ হোসেন চৌধুরী, রায়পুরা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক ভূঁইয়া ও মাধবদী থানা যুবদলের সদস্যসচিব শহীদুজ্জামান উল্লেখযোগ্য।
একই সময়ে নারায়ণগঞ্জে ১১টি মামলা দায়েরের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব মামলায় বিএনপির ৩১৫ জন নেতা–কর্মীর নাম উল্লেখ করা হয়। তাঁদের সঙ্গে অজ্ঞাতনামা আরও ৮০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৭০ জনকে। তাঁদের মধ্যে বিএনপির শতাধিক নেতা–কর্মী রয়েছেন বলে দলটির দাবি।
মানিকগঞ্জ সদর থানায় ১৭ জন নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ১৫–২০ জনের বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা করা হয়েছে। বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আটজন নেতা-কর্মীকে।
আগাম জামিন নিতে গতকাল হাইকোর্টে আসেন জামালপুর জেলা বিএনপির প্রায় ২০০ নেতা-কর্মী। হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে তাঁরা অভিযোগ করেন, তাঁরা সবাই ‘গায়েবি’ মামলার আসামি।
কোনো ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্য সাজানো মামলাকে বিএনপি ‘গায়েবি মামলা’ বলে থাকে।
পুলিশের কাজে বাধা, ভাঙচুর ও ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে দেশের ১২ জেলায় করা ২৯টি মামলায় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ৪৩৮ জন নেতা-কর্মী গতকাল হাইকোর্ট থেকে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন পেয়েছেন বলে জানা গেছে।
বিএনপির নেতা–কর্মীদের আইনজীবী ও দলটির কেন্দ্রীয় আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল প্রথম আলোকে বলেন, বানোয়াট অভিযোগে করা এসব মামলার উদ্দেশ্য হচ্ছে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের হয়রানি করা। মামলার অভিযোগের আইনগত ভিত্তি নেই। উচ্চ আদালত তাঁদের ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন দিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলার দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন।
১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশ সামনে রেখে ঢাকার আশপাশের জেলার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক–মহাসড়ক ও ঢাকার প্রবেশমুখে পুলিশের বিশেষ তল্লাশিচৌকি বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে ঢাকার সাভার, আশুলিয়া ও কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরের টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ, নরসিংদীর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে তল্লাশিচৌকি বসানো হতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো রাজনৈতিক সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিশেষ প্রস্তুতি নিতে হয়। বিএনপির সমাবেশের অবস্থা বুঝে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন প্রথম আলোর নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি)