সরেজমিন চর রাজিবপুর-১

দেশের দরিদ্রতম জনপদে বাঁচার লড়াই


উত্তর চর সাজাই গুচ্ছগ্রামে বাড়ি দিনমজুর শেখ ফরিদের (৩৫)। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি কাকডাকা ভোরে চরের আলপথ ধরে হেঁটে, ব্রহ্মপুত্রের হাঁটুপানি ডিঙিয়ে যান কর্তিমারী বাজারে। আশা ছিল, একটি কাজ পাবেন। বাজারে গিয়ে দেখেন, কামলা (দিনমজুর) বেশি, গৃহস্থ কম। ফলে কাজ আর মিলল না।

কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে উত্তর চর সাজাই গ্রাম। আর কর্তিমারী বাজার রৌমারীর যাদুরচর ইউনিয়নে। ফরিদের গ্রাম থেকে কর্তিমারী চার কিলোমিটার দূরে।

দিনমজুর শেখ ফরিদ কাজ পাননি। অন্যের গমখেত থেকে বথুয়া শাক তুলেছেন। এগুলো বাজারে বিক্রি করে ছেলেমেয়ের জন্য খাবার কিনবেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি চর রাজিবপুরের উত্তর চর সাজাই গুচ্ছগ্রামে।

২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ফরিদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্ত্রী সামেলা খাতুনসহ তিনি ঘরের বারান্দায় বসে বথুয়া শাকের আঁটি বাঁধছেন। ফরিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘুইরা আইসা মানুষের ক্ষেত থাইকা বইতা হাক (বথুয়া শাক) তুলেছি। ম্যালা খুঁইজা ১৪ আঁটি পাইছি। তিন আঁটি করে ১০-১২ টাকা ব্যাচা যাবে। ঘরের পেছনে বরইগাছ ঝাইড়া ১০-১২ কেজি বরই পাড়ছি। এন্যা (এগুলো) বেইচা পোলাপানগোরে খাওয়ানোর নিগা (জন্য) তরিতরকারি কেনা নাগব।’

সংক্ষেপে চর রাজিবপুর

# দেশের সবচেয়ে দরিদ্র উপজেলা কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর# উত্তরে রৌমারী, পূর্বে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে জামালপুর ও গাইবান্ধা, পশ্চিমে গাইবান্ধা ও চিলমারী উপজেলা।# আয়তন: ১১১.০৩ বর্গকিলোমিটার# উপজেলার জনসংখ্যা ৮৪ হাজার, দারিদ্র্যের হার ৭৯.৮ শতাংশ# জেলা সদর থেকে ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন, অনেকটা দ্বীপের মতো# কুড়িগ্রাম শহরে আসতে নদী পার হতে হয়

গত বছর দেশের ৫৭৭টি উপজেলা ও থানার দারিদ্র্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দারিদ্র্য মানচিত্র করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এতে দেখা যায়, রাজিবপুর, কোদালকাটি ও মোহনপুর—এই তিন ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত চর রাজিবপুর দেশের সবচেয়ে দরিদ্র উপজেলা, দারিদ্র্যের হার ৭৯ দশমিক ৮ শতাংশ। আর ২০১৬ সালের খানা আয়-ব্যয়ের তথ্যমতে, কুড়িগ্রাম দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জেলা। দারিদ্র্যের হার প্রায় ৭১ শতাংশ।

সম্প্রতি জেলার চর রাজিবপুরের বিভিন্ন গ্রাম ও চর ঘুরে শতাধিক দিনমজুর, কৃষক, বর্গাচাষি ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপে উঠে এসেছে তাঁদের অভাব ও দুর্দশার কথা। তাঁরা কাজের খোঁজে দিগ্বিদিক ছুটছেন। কৃষক ও বর্গাচাষিরা নিজেদের গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি বেচে বোরো মৌসুমের তেল, সারের খরচ সামলানোর চেষ্টা করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্যমতে, বন্যা ও নদের ভাঙনের মতো দুর্যোগের পাশাপাশি নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তাঁরা আরও দরিদ্র হচ্ছেন।

চরম খাদ্যসংকট

উত্তর চর সাজাই গুচ্ছগ্রামে ৪০-৪৫টি পরিবার বসবাস করে। তাদের মধ্যে অন্ধ, ভিক্ষুক, পঙ্গু মানুষও আছেন। এলাকায় এখন কাজ নেই। বেশির ভাগ পুরুষ কাজের খোঁজে ঢাকা বা টাঙ্গাইলে গেছেন। এসব পরিবারের নারী-শিশু-বৃদ্ধরা পড়েছেন চরম খাদ্যসংকটে।

চরের বাসিন্দা ফারজানা বেগম ১ বছরের ছেলেকে নিয়ে ঘাস তুলছেন। তাঁর ৪ বছর বয়সী আরেকটি ছেলে আছে। স্বামী রবিউল ইসলাম কাজের খোঁজে টাঙ্গাইলে গেছেন। ফারজানার সম্পদ বলতে একটি ছাগল। কিছুদিন আগে জন্মের সময় ছাগলের দুটি বাচ্চা মারা গেছে।

ফারজানা বলেন, স্বামী ১০ দিন আগে ৫০০ টাকা দিয়ে গেছেন। অল্প অল্প খরচ করছেন। ছাগলের চিকিৎসায় ২০০ টাকা গেছে। রাতে ডাল-ভাত খেয়েছেন। সকালে দুই বাচ্চাসহ পান্তাভাত খেয়েছেন। বাচ্চাদের একটা ডিম কিনে খাওয়ানোরও সামর্থ্য নেই তাঁর।

ফারজানার সম্পদ বলতে একটি ছাগল। তাঁর স্বামী রবিউল টাঙ্গাইল গেছে দিনমজুরি করতে। দুই ছেলেকে নিয়ে চরম খাদ্যসংকটে পড়েছে ফারজানা।

ফারজানা সরকারের যত্ন প্রকল্পের আওতায় গত বছর ১০ হাজার টাকা পেয়েছিলেন।
২৬ ফেব্রুয়ারি কোদালকাটি বাজারে কথা হয় দিনমজুর ফজলুল হকের সঙ্গে। তিনি কোমরের ব্যথা নিয়ে টাঙ্গাইলের সখীপুর থেকে ৪০ দিন পর বাড়ি ফিরছেন। তিনি বললেন, সাতজনের সংসার। জিনিসের অনেক দাম। ৪০ দিন যা উপার্জন করেছেন, বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই তা শেষ।

সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ১৫ টাকা দরে চাল তুলতে ডিলার আজগর আলীর বাড়ির উঠানে বসে ছিলেন রাজিবপুর সদর ইউনিয়নের সাইফুল ইসলাম। পরনে ছেঁড়া লুঙ্গি। বলেন, ‘রোজগার নাই। দিনে তিন কেজি চাল লাগে। ৩০ কেজি চালে কয় দিন চলে?’

প্রধান সমস্যা নদের ভাঙন

চর রাজিবপুর অনেকটা দ্বীপের মতো। জনসংখ্যা ৮৪ হাজার। জেলা সদর থেকে উপজেলাটি ব্রহ্মপুত্র নদে বিভক্ত। এখানে প্রধান সমস্যা নদের ভাঙন। বেশির ভাগ বসতিই অস্থায়ী।

সরেজমিন দেখা গেছে, ঘরগুলো আকারে ছোট। চালে টিন, বেড়া পাটখড়ির। নদে ভাঙা পরিবারগুলো অন্যের জমি চুক্তিভিত্তিক ভাড়া নিয়ে থাকে। বেশির ভাগই পেশায় দিনমজুর। সম্পদ বলতে এক-দুটি গরু, ছাগল আছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অমিত চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বললেন, নদের ভাঙনের কারণে মানুষ যাযাবরের মতো জীবনযাপন করছেন। তাঁর দাবি, ২০১৬ সালের আয়-ব্যয়ের তথ্য অনুযায়ী, রাজিবপুর দেশের সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষের উপজেলা। এখন অবস্থার উন্নতি হয়েছে।

সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ১৫ টাকা দরে চাল কিনে ছেলেসহ বাড়ি ফিরছেন সাইফুল ইসলাম। বললেন, দিনে ৩ কেজি চাল লাগে। ৩০ কেজি চালে কয়দিন চলে?

সরকারের স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির (এসএসকে) আওতায় বসতবাড়ির ধরন, ভিটেবাড়ি, আবাদি জমির পরিমাণ, খানাপ্রধানের আয়ের উৎস, শিক্ষা-চিকিৎসা ব্যয়, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিসহ ৪৩টি বিষয়ে রাজিবপুরের তথ্য সংগ্রহ করছে জরিপকারী দল।
এই দলের উপজেলা সমন্বয়ক মাইদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা গত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজিবপুরের ১৭ হাজার ৩১০ খানার মধ্যে ১৩ হাজার ৪১৫টির তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ অতিদরিদ্র। কোদালকাটির ২ নম্বর ওয়ার্ডে ৩০০ খানার মধ্যে ৩০ খানা পাওয়া গেছে। বাকিরা নদের ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়েছেন।

অভাবে সন্তান দত্তক

কোদালকাটি ইউনিয়নের শুক্কুর মেম্বারপাড়ার সাহিদা মা আয়েশা খাতুন, ছেলে সাজেদুল (১২), সাজু (৮) ও মেয়ে ফাতেমাকে (৬) নিয়ে একসঙ্গে থাকেন। বড় মেয়ে জোসনার (১৩) পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয়েছে। জোসনার ছেলে জুনাইদের বয়স দেড় বছর।

নুর হোসেনের কোলে সাহিদার মেয়ে কুলসুম। পাশে নুর হোসেনের স্ত্রী রাবেকা বেগম। নুর হোসেন-রাবেকা দম্পতি কুলসুমকে দত্তক নিয়েছেন।

সাহিদার দেড় বছর বয়সী আরেকটি মেয়ে আছে। নাম কুলসুম। জন্মের ৪১ দিন পর তাকে রৌমারী উপজেলার বকবান্দার নুর হোসেন-রাবেকা দম্পতির কাছে দত্তক দেন। এখন কুলসুমের নাম নাদিয়া।

২৮ ফেব্রুয়ারি বিকেলে বাড়িতে গিয়ে জানা গেল, সাহিদা চরে মরিচ তুলতে গেছেন। তাঁর মা আয়েশা বলেন, সাহিদার স্বামী ইবরাহিম আলী চার বছর আগে হঠাৎ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। সাহিদা তখন থেকে দিনমজুরি করেন। কুলসুমের জন্মের সময় তাঁর কাজ বন্ধ থাকলে পরিবারটি অসহায় হয়ে পড়ে।

সাহিদার বড় মেয়ে জোসনা আঙিনায় বসে মাছ কুটাবাছা করছেন। পাশে তাঁর (জোসনা) ছেলে জোনাইদ। সাহিদা বললেন, এসব মাছ তাদের নয়। প্রতিবেশী এক নারী কুটাবাছা করতে দিয়েছেন।

আয়েশা জানান, তাঁরা ভূমিহীন। ভাগনে জহিরুল এই জায়গায় আশ্রয় দিয়েছেন। আগে একটি ঘর ছিল। কিছুদিন আগে শোলা (পাটখড়ি) ও পলিথিন দিয়ে আরেকটি ঘর তুলেছেন। এই ঘরে তিনি থাকেন। একটি গরুও আছে। তিন মাস আগে জ্যাঠাতো ভাই ইমানের কাছ থেকে গরুটি আদি (ভাগে নেওয়া) নিয়েছেন।

পড়ন্ত বিকেলে সাহিদা বাড়ি ফেরেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছয়-সাতজন মানুষ একহাতে পালতে হয়। বাচ্চা হইল, ইনকাম (আয়) করে খাওয়াইনোর কেউ নেই। সেই জন্য মানুষকে দিছি।’

সাহিদা গত দুই বছর ভিজিডির চাল পেয়েছিলেন। এবার নাম বাদ গেছে। তাঁর মা আয়েশা ছয় মাস হলো বিধবা ভাতা পাচ্ছেন। বিকেল শেষে সন্ধ্যা নামে। সাহিদার দুই ছেলে সাজেদুল ও সাজু তখনো ঘরে ফেরেনি। তারা অভাবে পড়াশোনা বাদ দিয়েছে। প্রতিবেশী শামিমা আক্তার ও হনুফা বেগম বলেন, ছেলে দুটি ঘুঘু ধরে ২০ টাকা পেলে আনাজ (তরকারি) আনে। মাকে টাকা দেয়।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মাসুদ আহমেদ বলেন, তাঁর ওয়ার্ডের ৩০০ খানার মধ্যে ২০০টির চিত্র কমবেশি একই।

যা বললেন উমর আলী

রাজিবপুর হাটে একটি বকনা গরু বেচতে যাচ্ছেন উমর আলী ও তাঁর ছেলে ইব্রাহিম। ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে টাঙ্গালিয়াপড়ার খাজার ঘাটে।

উমর আলী ও তাঁর ছেলে একটি বাছুর বিক্রি করতে ইব্রাহিম রাজিবপুর হাটে যাচ্ছিলেন। তিনি ৩০ শতাংশ জমি বর্গা নিয়ে আবাদ করছেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গালিয়াপাড়ার খাজার ঘাটে তিনি বলেন, বোরো খেতের ডিজেল ও সার কিনতে টাকা লাগবে। ধান কিনতে হবে। ছেলে কাজ করতে টাঙ্গাইলে যাবেন। তাঁকে যাতায়াতভাড়া দিতে হবে। এ জন্য গরু বিক্রি ছাড়া উপায় নেই।

এক পোয়া মরিচ

ব্যাগে করে বাজারে মরিচ বিক্রি করতে যাচ্ছেন বজলার রহমান। নতুনগ্রাম দক্ষিণ চর সাজাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে।

বজলার রহমান যাচ্ছিলেন রাজিবপুর বাজারে। দক্ষিণ চর সাজাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ কেজি কাঁচা মরিচ নিয়ে হাটে যাচ্ছেন। তাঁর ভাষ্য, এক পোয়া (২৫০ গ্রাম) মরিচের দাম ২৫ টাকা। এর বেশি কেউ কেনেন না। তাই এক পোয়া করে প্যাকেট করেছেন।

১২ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রামের রৌমারী ও চর রাজিবপুর ঘুরে গেছে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়াসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ দাবি করেন, রাজিবপুরের চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বেশ কিছু কর্মসূচি নেওয়া হবে। একেবারে দরিদ্র পরিবারগুলোকে বাছাই করে তাদের জন্য আলাদা কিছু করা যায় কি না, সেটাও ভাবা হচ্ছে।

 আয় কম বেদেনির

গ্রামে গ্রামে সাপের খেলা দেখিয়ে রোজগার করেন হাজরা বেগম। ২৩ ফেব্রুয়ারি চর রাজিবপুর ইউনিয়নের মোস্তানমোড়ে।

গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর থেকে ৮-১০টি বেদে পরিবার ১২ দিন আগে চর রাজিবপুরে এসেছে। তারা গ্রামে গ্রামে সাপের খেলা দেখিয়ে আয় করে। তাদের একজন হাজরা বেগম গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরে বলেন, ‘আগে সাপের খেলা দেখালে মানুষ আধা কেজি, এক কেজি করে চাল দিত। এখন একমুঠো দেয় না। মানুষের অবস্থা ভালো না।’