সূর্য যখন পাটে নামে, তখন পরিপাটি সাজানো ইফতারির টেবিলে প্রথমেই যেদিকে নজর যায়, সেটি শরবত। মাগরিবের আজানের ধ্বনি ভেসে আসার পর স্বচ্ছ কাচের গ্লাসে লেবুর মিষ্টি ঘ্রাণ মেশানো ঠান্ডা এক গ্লাস শরবতে যে তৃপ্তি, তা সারা দিনের রোজার ক্লান্তি যেন শুষে নেয়। মুহূর্তেই শরীর, মনে ফিরে আসে সজীবতা।
ইফতারে ঠিক কবে থেকে শরবতের প্রচলন, তা বলা কঠিন। ঢাকার খাবারে মোগলদের দাপটই বেশি। লেখক ও গবেষক হাকিম হাবিবুর রহমান ঢাকা পঞ্চাশ বছর আগে বইতে জানাচ্ছেন, আজ থেকে এক-দেড় শ বছর আগে যে মৌসুমেই রমজান হোক না কেন, ঢাকায় পুদিনাপাতা, ক্ষীরা আর ধনেপাতা পাওয়া যেত। আর পাওয়া যেত আখ। গোলাপ বা কেওড়া ফুলের পাপড়ি দিয়ে সুবাসিত করা হতো এগুলো। বেশি প্রচলন ছিল ফালুদা ও তোকমার শরবত। বেলের শরবতও ছিল তালিকায়।
পুরান ঢাকার শরবতে যেমন মোগল ঐতিহ্য তেমনি আবার বনানী, গুলশান এলাকার শরবতে আধুনিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায়।
ইফতার আয়োজনে ঘরে-বাইরে এখন দেখা মেলে হরেক রকমের শরবতের। কোনোটা বেশি মিষ্টি তো কোনোটা হালকা মিষ্টি। কোনোটা আবার একটু টক মেশানো। কোনোটা আবার দুধ, বাদাম, পেস্তায় মিশে রীতিমতো সমৃদ্ধ। ইফতার আয়োজনের শরবতে এখন মিশেছে চিয়া সিড, ইসবগুল, পুদিনাপাতাও। আর মৌসুমের একেক ফল দিয়ে বানানো একেক স্বাদের শরবত তো রয়েছে। বাঙ্গি, তরমুজ, আনারস, পেঁপে, আপেল, কমলা—সব ফলেরই তাজা শরবত দিয়ে ইফতার করেন অনেকে। তালিকায় আছে ক্র্যানবেরি, স্ট্রবেরিও। তবে তাতে খরচটা বেশি।
এত পদের শরবত দেখে মাঝে মাঝে চোখ কপালে ওঠে। বেশি দিন আগের কথা নয়, ২৫–৩০ বছর আগেও গ্রামাঞ্চলে ইফতারে শরবত বানানো হতো গুড় দিয়ে। আর ছিল বাতাসার শরবত। এখনো অনেকে গুড়ের শরবত বানান। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে লেবু, তোকমাসহ কত কী।
সারা দিনের রোজার পরে সুসজ্জিত রেস্তোরাঁয় বসে সুস্বাদু শরবতে চুমুক দিয়ে যেমন তৃপ্তি মেলে, তেমনি সাদামাটা লেবুর শরবতের চুমুকেও কিন্তু তৃপ্তি কিছু কম নয়।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও রয়েছে শরবতের বৈচিত্র্য। সিলেটিদের কাছে প্রিয় চিড়ার শরবত, বরিশাল ও খুলনায় আবার ইফতারে প্রিয় পোলাওয়ের চাল, আখের গুড়, নারকেল বাটা মেশানো মলিদা শরবত। বগুড়ায় ইফতারে প্রিয় টক দইয়ের ঘোল।
তবে ঢাকা এক অদ্ভুত শহর। এ শহরে কেউ যখন ফুটপাত থেকে কেনা সস্তা রং মেশানো শরবত দিয়ে ইফতার করেন, তখন কেউ গুলশান, বনানীর ঝাঁ–চকচকে রেস্তোরাঁয় বসে দিল্লির বিখ্যাত মোহাব্বত কা শরবত পান করেন।
পুরান ঢাকার আনন্দ জাফরানি, ডিসেন্ট স্পেশাল কাশ্মীরি, রয়্যাল পেস্তা শরবত ঐতিহ্যবাহী পানীয়। মোগল ঐতিহ্য অনুসরণ করে দুধ, মালাই, পেস্তা, জাফরান ও চিনি দিয়ে এসব শরবত তৈরি হয় বলে জানান প্রস্তুতকারকেরা। অনেক উপাদান আনা হয় দেশের বাইরে থেকেও। ইফতারে বিউটির লাচ্ছির সমাদর বহু বছর ধরেই।
ইফতার আয়োজনে ঘরে-বাইরে এখন দেখা মেলে হরেক রকমের শরবতের। কোনোটা বেশি মিষ্টি তো কোনোটা হালকা মিষ্টি। কোনোটা আবার একটু টক মেশানো। কোনোটা আবার দুধ, বাদাম, পেস্তায় মিশে রীতিমতো সমৃদ্ধ।
পুরান ঢাকার শরবতে যেমন মোগল ঐতিহ্য তেমনি আবার বনানী, গুলশান এলাকার শরবতে আধুনিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায়। বনানীর বুস্ট জুস, ধানমন্ডির ঠান্ডা গরম, সিদ্ধেশ্বরীর ক্যাফে গেলেটেরিয়া, মোহাম্মদপুর টাউন হলের সিঙ্গাপুর জুস কর্নারের মতো দোকানগুলোয় ক্র্যানবেরি, ব্লু বেরি, স্ট্রবেরির শরবত পাওয়া যায়।
ইফতারে শরবতের জায়গা এখন অনেকটা জুড়ে নিয়েছে বিভিন্ন ধরনের শেক। মিল্ক শেক, চকলেট মিল্ক শেক, স্ট্রবেরি শেক এই প্রজন্মের মানুষের কাছে ইফতারে বেশ জনপ্রিয়। আবার লালমাটিয়ায় বিটরুটের শরবত, খিলগাঁওয়ে ডাবের পানি ও শাঁস মেশানো কোকোনাট শ্ল্যাস ইফতারে কম জনপ্রিয় নয়।
কেবল দুধ, বাদাম বা ফলের শরবত নয়, দই দিয়েও বানানো হয় শরবত। ইফতারের অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুরও মেশানো হয় শরবতে। পুরান ঢাকার বেশ কিছু দোকানে পাওয়া যায় দিলখুশ আজোয়া, দিলবাহার আজোয়া নামের শরবত। নামে যেমন রাজকীয়, স্বাদেও তেমনি ভরপুর এসব শরবত।
প্রতিদিন ইফতারিতে নতুন ধরনের শরবত পান করতে পছন্দ করেন খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা জোহরা খাতুন। তিনি বললেন, ‘ডাবের পানি ও শাঁস মেশানো কোকোনাট শ্ল্যাস একদমই নতুন স্বাদ। বিভিন্ন ধরনের মিল্ক শেক থেকেও এটি বেশি সুস্বাদু।’
শরবতের এমন বৈচিত্র্যময় জগৎ কিন্তু কেবল ঘরের বাইরে নয়। ঘরেও এখন অনেকে বানান রকমারি শরবত। বাঙ্গি, খেজুর, বাদাম বা কমলা, মাল্টা, তরমুজ ব্লেন্ডারে ঘোরালেই তৈরি হয় মজার শরবত। বাইরের তুলনায় ঘরে বানানো শরবত যেমন স্বাস্থ্যকর হয়, তেমনি পকেটের স্বাস্থ্যটাও ভালো থাকে।
ডাবের পানি ও শাঁস মেশানো কোকোনাট শ্ল্যাস একদমই নতুন স্বাদ। বিভিন্ন ধরনের মিল্ক শেক থেকেও এটি বেশি সুস্বাদু।খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা জোহরা খাতুন
রাজধানীর পান্থপথের একটি রেস্তোরাঁয় ইফতারির পাশাপাশি থাকে হরেক রকম শরবত। কোন ধরনের শরবত ক্রেতাদের বেশি পছন্দ জানতে চাইলে বিক্রেতা বলেন, ‘গরম থাকায় পুদিনাপাতা ও লেবু, চিয়া সিড, ইসবগুলের শরবত বেশি কিনছেন ক্রেতারা।’
ইফতারে শরবতের বিকল্প নেই। সারা দিনের রোজার পরে সুসজ্জিত রেস্তোরাঁয় বসে সুস্বাদু শরবতে চুমুক দিয়ে যেমন তৃপ্তি মেলে, তেমনি সাদামাটা লেবুর শরবতের চুমুকেও কিন্তু তৃপ্তি কিছু কম নয়। তাই তো যুগ যুগ ধরে ইফতারে শরবত রয়েছে অনড় অবস্থানে। আর তাতে এসেছে নানা বৈচিত্র্য।