বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে স্মরণসভা ডাকা হয়েছিল। ছাত্রলীগ সেখানে বাধা দিতে গেলে সভার আয়োজক ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তাঁদের বাগ্বিতণ্ডা থেকে মারামারি বাধে। পরে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীদের পেটান ও ধাওয়া দেন। এ সময় দুই পক্ষ পরস্পরকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। অবশ্য ধাওয়ায় টিকতে না পেরে ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।
আজ শুক্রবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ছাত্রলীগের হামলায় ১৩ নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ছাত্র অধিকার পরিষদ। এ ঘটনায় ছাত্রলীগেরও কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে আজ বেলা তিনটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ‘আবরার ফাহাদ স্মৃতি সংসদ’-এর ব্যানারে স্মরণসভার আয়োজন করেছিল ছাত্র অধিকার পরিষদ। পরিষদের নেতা-কর্মীরা কর্মসূচি করতে সেখানে যান। ৩টা ২০ মিনিটে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়বিষয়ক সম্পাদক আল-আমিন রহমান, মানবসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক নাহিদ হাসান এবং নাট্য ও বিতর্কবিষয়ক সম্পাদক ফয়সাল মাহমুদের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের একদল নেতা রাজু ভাস্কর্যে যান। তাঁরা পরিষদের নেতা-কর্মীদের বলেন, বহিরাগত ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কর্মসূচি করতে হবে। এ নিয়ে ছাত্র অধিকার পরিষদের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আখতার হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক আকরাম হোসাইনের সঙ্গে তাঁদের বাগ্বিতণ্ডা হয়। তবে একপর্যায়ে তাঁরা সেখান থেকে চলে যান।
বেলা সাড়ে তিনটার দিকে যখন মাইকে আবরারের স্মরণসভার বক্তব্য শুরু হয়, তখন রাজু ভাস্কর্যের সামনের রাস্তায় রাখা চেয়ারে বসেছিলেন ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীরা। এ সময় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব খান, সাংগঠনিক সম্পাদক নাজিম উদ্দিন, কর্মসংস্থানবিষয়ক সম্পাদক রনি মুহাম্মদ, মানবসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক নাহিদ হাসান, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়বিষয়ক সম্পাদক আল-আমিন রহমান, উপদপ্তর সম্পাদক মিরাজুল ইসলাম খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলামসহ একদল নেতা-কর্মী সেখানে যান। তাঁদের সঙ্গে ছাত্র অধিকার পরিষদের কিছু নেতা-কর্মীর বাগ্বিতণ্ডা শুরু হয়। এর মধ্যেই ভাস্কর্যের পাদদেশে দাঁড়িয়ে মাইকে বক্তব্য দিতে থাকেন ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা। ইয়ামিনের ঠিক পেছনে পরিষদের নেতা তারেকুল ইসলামসহ কয়েকজনের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতা নাজিম উদ্দিনসহ কয়েকজনের মারামারি বেধে যায়। একপর্যায়ে পরিষদের নেতা বিন ইয়ামিন, আকরামসহ সবাই মিলে ‘সন্ত্রাসীদের আস্তানা, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন।
এ সময় লাঠিসোঁটা, লোহার পাইপ হাতে আশপাশ থেকে রাজু ভাস্কর্যে যান ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তাঁদের একটি অংশ ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীদের পেটাতে থাকে, আরেকটি অংশ স্মরণসভার চেয়ার ভাঙচুর করে। জগন্নাথ হলের ক্যানটিনের কর্মচারী শাকিল মিয়াকেও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে চেয়ার ভাঙচুর করতে দেখা যায়। পরে পরিষদের নেতা-কর্মীদের টিএসসি থেকে শাহবাগ অভিমুখী সড়কে ধাওয়া দেয় ছাত্রলীগ। শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি কামাল উদ্দীন ও সাধারণ সম্পাদক রুবেল হোসেন এ ধাওয়ায় নেতৃত্ব দেন। ধাওয়া খেয়ে ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। তবে মিনিটখানেক দুই পক্ষই পরস্পরকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এরপর রাজু ভাস্কর্যের সামনে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপদপ্তর সম্পাদক রাহিম সরকারের নেতৃত্বে স্মরণসভার ব্যানার-ফেস্টুনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
ছাত্রলীগের হামলায় ছাত্র অধিকার পরিষদের অন্তত ১৩ নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা। তাঁদের মধ্যে তিনিসহ (ইয়ামিন) মাথায় ও হাতে আঘাত পেয়েছেন এবং সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক আকরাম হোসাইন লাঠির আঘাতে গুরুতর আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে আরও আছেন কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি শাকিল আহমেদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হাসান, প্রচার সম্পাদক রাসেল আহমেদ প্রমুখ। ইয়ামিন জানান, আহত ১৩ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বিন ইয়ামিন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিন্নমত পোষণ করলেই ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের খুন করে ফেলে। আমাদের আজকের কর্মসূচিটি ছিল তাদের সরাসরি চপেটাঘাত করার মতো। সে জন্য তারা আমাদের ওপর হামলা করেছে। আমরা আজ কোনো উসকানিমূলক বক্তব্য দিইনি। ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
গণ অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক আবু হানিফ জানিয়েছেন, ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতি আখতারসহ প্রায় ১৫ জনকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে ঢাকা মেডিকেল থেকে।
এদিকে ছাত্র অধিকার পরিষদের হামলায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজিম উদ্দিনসহ কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতা।
ঘটনাস্থলে থাকা ছাত্রলীগের নেতা মাহবুব খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কর্মসূচি করার অধিকার রাখেন। কিন্তু তাঁরা (ছাত্র অধিকার) একজনও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডিকে তাঁদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরিচয়পত্র চেক করতে বলি। তখনই তাঁরা একটা উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন, উসকানিমূলক স্লোগান দেন এবং বহিরাগত ব্যক্তিদের নিয়ে ক্যাম্পাসে কর্মসূচি করার প্রতিবাদ জানাতে আসা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেন। আমরা কারও ওপর হামলা করিনি। হামলার রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাস করি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মৌলবাদকে চিরদিনের জন্য ক্যাম্পাস থেকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে।’
এ ঘটনার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্র অধিকার পরিষদ নামের সংগঠনটি ছাত্রশিবিরের পুনর্বাসনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সব সময়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশকে তারা বিনষ্ট করার চেষ্টা করে। তাই শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাদের প্রতিহত করার একটি প্রচেষ্টা তো রয়েছেই। সেই জায়গা থেকে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিহত করেছেন। তবে এর সঙ্গে সাংগঠনিকভাবে ছাত্রলীগের সম্পৃক্ত থাকার সুযোগ নেই। যাঁরা গেছেন, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবেই তাঁদের প্রতিহত করতে গেছেন। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, তারাও (পরিষদ) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়েছে, আঘাত করেছে।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হল থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় আবরারের বাবা চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে বুয়েটের ২৫ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। আসামিরা সবাই বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত নেতা-কর্মী। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান। এ মামলায় ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।