অযত্ন–অবহেলায় ইউরোপিয়ান ক্লাব

বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের স্মৃতিধন্য ক্লাবটির এখন জীর্ণ দশা। অথচ এখানে রচিত হয়েছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এক বীরত্বগাথা।

প্রীতিলতার স্মৃতিবিজড়িত ইউরোপিয়ান ক্লাব এখন বেহাল। গতকাল বেলা একটায় নগরের পাহাড়তলীতে

পশ্চিমমুখী লাল ইটের একটা একতলা ভবন। ওপরে টিনের ছাউনি। সামনের দিকে তিন স্তরের কাঠের কারুকাজ। কাঠের ওপর ফুলের খাঁজকাটা নকশাগুলো এখনো ব্রিটিশ আমলের স্মৃতি বহন করে চলেছে। দক্ষিণে ছয়টি কাঠের ভাঙাচোরা দরজা। সামনের দিকে কাঠের অক্ষরে ইংরেজিতে নামফলক, ‘ইউরোপিয়ান ক্লাব, চট্টগ্রাম।’ যদিও কয়েকটি অক্ষর সেখান থেকে ঝরে গেছে।

বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের স্মৃতিধন্য এই ক্লাবের এখন জীর্ণ দশা। অথচ ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর এখানে রচিত হয়েছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এক বীরত্বগাথা। ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করার পর প্রাণ দিয়েছিলেন প্রীতিলতা। বাংলার প্রথম নারী শহীদ এই বীরকন্যা।

প্রীতিলতাকে নিয়ে রচিত বীরকন্যা প্রীতিলতা গ্রন্থে পূর্ণেন্দু দস্তিদার উল্লেখ করেছেন, ১৯৩২ সালের ১৩ জুন পটিয়ার ধলঘাটের সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে সূর্য সেনের সঙ্গে প্রীতিলতার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। প্রীতিকে নিয়ে সেখানে যান বিপ্লবী অপূর্ব (ভোলা সেন)। ওই রাতেই সেখানে মিলিটারি হানা দেয়। বিপ্লবীদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। তাতে ক্যাপ্টেন ক্যামেরুন মারা যান। শহীদ হন বিপ্লবী নির্মল সেন ও ভোলা সেন।

ওই ঘটনার পর সূর্য সেন ও প্রীতিলতা সেখান থেকে শহরে চলে আসেন। ধীরে ধীরে প্রীতিলতা নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করেন। বিপ্লবীরা টার্গেট করেন পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের। এই ক্লাবের বাইরে লেখা ছিল, ‘কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ।’ এটা তাতিয়ে দিয়েছিল বিপ্লবীদের। এই অপারেশনের ভার এসে পড়ে বিপ্লবী প্রীতিলতার ওপর।

এর আগেও একবার ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল ওই ক্লাব আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু সেদিন গুড ফ্রাইডে উপলক্ষে ক্লাব বন্ধ ছিল। অবশেষে আসে সেই কাঙ্ক্ষিত ক্ষণ। ২৩ তারিখ রাতে অপারেশন হলেও ২৪ সেপ্টেম্বরকে প্রীতিলতার আত্মাহুতি দিবস ধরা হয়।

লেখিকা মালেকা বেগম কীর্তিমান বাঙালি-প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার গ্রন্থে ক্লাব আক্রমণের বর্ণনা তুলে ধরেন, ‘কাট্টলীর সমুদ্রতীরে প্রীতিলতা ও অন্যান্য বিপ্লবীরা অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ করেন। ক্লাবের একজন বাবুর্চির সহায়তায় বিপ্লবীরা সব খবর আগেভাগে জেনে গিয়েছিলেন। সফলভাবে অভিযান শেষ করে দলের নেতা হিসেবে প্রীতিলতা সবাইকে বের করে নিজে বের হলেন সবার শেষে। হঠাৎ একটা গুলি এসে প্রীতিলতার বুকে লাগে।  বন্দীত্ব এড়াতে সায়ানাইড খেয়ে আত্মাহুতি দেন।’

ইউরোপিয়ান ক্লাব ছিল মূলত ব্রিটিশদের বিনোদনের একটা জায়গা। এই ক্লাবে আক্রমণ করে ব্রিটিশদের শৌর্যবীর্যে আঘাত হেনেছিলেন প্রীতিলতারা। পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী সেদিন প্রীতিলতার নেতৃত্বে ইউরোপিয়ান ক্লাবে আক্রমণে এক ইংরেজ নারী নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়।

বীরকন্যা প্রীতিলতার ভাস্কর্যের ওপর ধুলার আস্তরণ জমা হয়েছে। গতকাল বেলা একটায় চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়তলী এলাকায়

সেই ইউরোপিয়ান ক্লাবটির এখন হতশ্রী অবস্থা। একবার ক্লাবের চারদিকটা ঘুরে আসা যাক। ক্লাবের পেছনের দিকে ছিল ঘন জঙ্গলঘেরা পাহাড়। এখন পাহাড় সেভাবে আর অবশিষ্ট নেই। একতলা লাল ইটের ভবনটির এখন হতশ্রী অবস্থা। ভেতরে খালি। ভবনটির পেছনের কাঠের দরজাটির নিচের অংশ ভেঙে গেছে। কুকুর–বিড়াল যাতে ভেতরে ঢুকতে না পারে, সে জন্য সেখানে ইটের একটা পাথর দিয়ে রেখেছে। দক্ষিণে ভবনের একটি কাঠের খুঁটি হেলে পড়েছে। দরজাগুলোর নড়বড়ে অবস্থা। সামনের খিড়কির কাচের অংশটুকু ভেঙে গেছে।

বীরকন্যা প্রীতিলতা ট্রাস্টের সভাপতি পঙ্কজ চক্রবর্তীসহ অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে ক্লাবটি সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। পঙ্কজ চক্রবর্তী বলেন, বারবার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রেল মন্ত্রণালয় সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এখনো তেমন কিছু হয়নি।

রেলওয়ের বিভাগীয় প্রকৌশলী আবদুল হানিফ বললেন, ‘মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের পর আমরা সেখান থেকে অফিস সরিয়ে নিয়েছি। প্রীতিলতার স্মৃতি সংরক্ষণ করা হবে এখানে।’