রামিসা চৌধুরী গাইছিলেন—‘জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা।’ হারমোনিয়ামে পরের গানটি ধরলেন—‘আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি মন বান্ধিবি কেমনে?’ হয়তো গানের এই কথাগুলোর মতোই রামিসার জীবন। তাঁকে নিয়ে নানা গুঞ্জন। তিনি নিজের শারীরিক গঠনের সঙ্গে মনের মিল খুঁজে পান না।
রামিসা নিজেকে পরিচয় দেন ট্রান্সওমেন বা রূপান্তরিত নারী হিসেবে। তবে তিনি শারীরিকভাবে একজন পুরুষ। তিনি অস্ত্রোপচার করাননি। যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা (সিডিসি) বলছে, ট্রান্সজেন্ডার হচ্ছে যাঁদের সেক্স (জৈবিক লিঙ্গ পরিচয়) ও জেন্ডার আইডেনটিটি (লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক পরিচয়) আলাদা।
রামিসা বলেন, একদম ছোটবেলায় যখন নারী বা পুরুষের ভেদাভেদ বুঝতে পারতেন না, তখন শুধু ভালো লাগে বলে মায়ের শাড়ি পরতেন। বোনের জামা গায়ে দিতেন। লিপস্টিক দিতেন। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে ভালো লাগত।
রামিসার বাবা সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালাতেন। ১৫ বছর আগে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করে অন্য জায়গায় চলে যান। রামিসা বললেন, ‘বাবার দ্বিতীয় বিয়ের কারণ ছিলাম আমি। বাইরে থেকে মানুষের মুখে নানা কথা শুনে এসে বাড়ি ফিরে মাকে পেটাতেন বাবা। আমাকে মেরে ফেলার জন্য কয়েকবার ওপরে তুলে আছাড় দিয়েছেন। পরে আমাদের ফেলে চলেই গেলেন।’
পারিবারিক এসব অশান্তিতেও দমে যাননি রামিসা। ছোটবেলা থেকে গান গাইতে পছন্দ করতেন। ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ পরিচালিত একটি স্কুলে গান শেখার সুযোগ পান। তিনি রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় সরকারি সংগীত কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক (আই মিউজিক) পাস করেছেন। এবার স্নাতকে ভর্তি হবেন। ২০১৩ সালে শিশু বয়সে একটি প্রকল্পের অধীনে সংগীত শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ‘সুরের ধারা’র সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। জানালেন, সুরের ধারাতেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাঁর গানের হাতেখড়ি হয়। গত বছরের জুলাই থেকে এ প্রতিষ্ঠানেই সহকারী শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রেলস্টেশনে যেসব শিশু বড় হচ্ছে, ওই শিশুদের গান শেখানোসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছেন।
রামিসা নিজেকে সংগীতশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। সংগীত নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করতে চান। জানালেন, ছোটবেলায় খেয়ে না খেয়ে বড় হয়েছেন। দুই মাসের বাড়িভাড়া দিতে না পারায় বাড়ির মালিক ঘরে তালা দিয়ে ভাই, বোন, মাসহ সবাইকে বাইরে বের করে দিয়েছিলেন। রাস্তায় মাথার নিচে ইট দিয়ে ঘুমিয়েছেন অনেক সময়।
গান প্রসঙ্গে রামিসা ‘জল তরঙ্গ’ নামের একটি গানের দলের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। এ গানের দলে অন্যদের সঙ্গে রামিসাও গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এ দলের পক্ষ থেকেই রামিসার গানের ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছে। আর তাতে রামিসার পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা বেড়েছে। ফেসবুকের পোস্টে মন্তব্যের ঘরে অনেকে রামিসাকে সাধুবাদ দিচ্ছেন।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধের এক বস্তিতেই পরিবারের সঙ্গে বড় হয়েছেন রামিসা। জানালেন, এখনো তাঁরা সেই এলাকাতেই আছেন, শুধু আগের তুলনায় আরেকটু ভালো বাসায় থাকছেন।
রামিসা ছাড়া তাঁর অন্য দুই বোন ও দুই ভাই তেমন একটা পড়াশোনা করেননি। বড় ভাই বিয়ে করেছিলেন, পরে স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এই ভাই একসময় বাস চালাতেন, এখন আর তেমন কোনো কাজ করেন না। তিনি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছেন। বড় ভাই আর আরেক ছোট ভাইকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে একই বাসায় থাকছেন রামিসা। তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় গান গেয়ে কিছু টাকা পান। বর্তমানে সুরের ধারা থেকেও বেতন পাচ্ছেন। মূলত এ টাকা দিয়েই চলে পুরো পরিবার। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে।
রামিসা বলেন, ‘মা ছোটবেলায় বোঝাতেন, আমি ছেলে হয়েও কেন মেয়েদের মতো চলাফেরা করি। একটু একটু করে বুঝতে শুরু করি, আমি অন্য আট-দশজন মানুষের থেকে আলাদা। আমার শরীর পুরুষের হলেও সত্তায় আমি একজন নারী। তখন মাকে বলতাম, আমি তো এসব ইচ্ছে করে করছি না। মা কাঁদতেন বা এখনো কাঁদেন, তবে আমাকে কিছু বলেন না। পাড়াপড়শিদের আমাকে নিয়ে যত অভিযোগ, সব মাকে শুনিয়ে যান। সেসব শুনে মা মন খারাপ করেন।’
‘আমাদের খাওয়ানোর জন্য মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেছেন। বিয়েবাড়ির বাসন মেজেছেন। এখন বয়স হয়েছে বলে আর এ কাজ করতে পারেন না। আমার মা অশিক্ষিত এবং দরিদ্র হতে পারেন, কিন্তু তিনি আমাকে কোনো দিন অবহেলা করেননি বা আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেননি’—বলেন রামিসা।
স্কুলে ভর্তির পর থেকেই মূলত রামিসা তাঁর প্রতি যে অন্যরা বৈষম্যমূলক আচরণ করছেন, তা বুঝতে শুরু করেন। কলেজেও অনেকে রামিসাকে নিয়ে ঠাট্টা–বিদ্রূপ করতেন। ফলে নিয়মিত কলেজে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ফলও খারাপ হয়েছে। বললেন, অনেক শিক্ষক যখন ঠাট্টা–বিদ্রূপ করতেন বা করেন, সেটাই সবচেয়ে বেশি মন খারাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
রামিসা বললেন, এখন খুব বেশি না হলেও সমাজে তাঁর একটি পরিচিতি হয়েছে। তারপরও বাসের সহকারী বাসে তুলতে চান না। শাড়ি পরে বাসে উঠলেও নারীদের সিটে বসতে দেন না। রামিসা সিটে বসলে পাশের সিট খালি থাকলেও সেখানে কেউ বসতে চান না। বসলেও এমনভাবে বসেন যেন তিনি রামিসাকে দেখে ভয় পাচ্ছেন। অথবা রামিসা তালি দিয়ে টাকা চেয়ে বসবেন কি না, হয়তো সে ভয়ও পান অনেকে। তবে রামিসা এখন আর এসব তেমন গায়ে মাখেন না।
রামিসা নিজেকে সংগীতশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। সংগীত নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করতে চান। জানালেন, ছোটবেলায় খেয়ে না খেয়ে বড় হয়েছেন। দুই মাসের বাড়িভাড়া দিতে না পারায় বাড়ির মালিক ঘরে তালা দিয়ে ভাই, বোন, মাসহ সবাইকে বাইরে বের করে দিয়েছিলেন। রাস্তায় মাথার নিচে ইট দিয়ে ঘুমিয়েছেন অনেক সময়।
রামিসা বললেন, জীবনে যত ঝড়ঝাপটা আসুক, তিনি কখনো বাড়ি ছাড়েননি। পড়াশোনা এবং গান ছাড়েননি। এই গানের মধ্যেই কাটিয়ে দিতে চান পুরো জীবন। তবে রামিসার মতে, ট্রান্সজেন্ডারদের নিজেদের উদ্যোগে নিজেদের যোগ্যতায় সামনে এগিয়ে যেতে হবে। এ চলার পথে সুরের ধারা, জল তরঙ্গের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান যেমন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে, তেমনি অনেকে অসহযোগিতা করবেন। তবে থেমে গেলে চলবে না।
রামিসা মনে করেন, তাঁর মতো লিঙ্গবৈচিত্র্যের মানুষেরাও যে সমাজের অন্যদের মতো জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন, তা প্রমাণ করতে হবে।