রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) সামনে কয়েক ঘণ্টা ধরে বিক্ষোভ করছেন জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে আহত ব্যক্তিরা। সরকারের ভূমিকায় অসন্তোষ জানানোর পাশাপাশি নিজেদের চরম দুর্দশার কথাও তুলে ধরেছেন তাঁরা। বলছেন, এই আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের সহায়তা করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যে অর্থ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তা এখনো তাঁরা হাতে পাননি। তাঁদের অনেককেই এখন মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে।
হাসপাতালের শয্যা ছেড়ে রাস্তায় নেমে আহত ব্যক্তিদের এই বিক্ষোভ চলছে দুপুর থেকে। ঘটনার শুরু হয় স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম সকালে পঙ্গু হাসপাতাল পরিদর্শনে যাওয়ার পর। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের দেখতে বেলা ১১টার দিকে ওই হাসপাতালে যান তিনি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সবার সঙ্গে দেখা করেননি—এ অভিযোগে হাসপাতাল থেকে বেরোনোর পথে তাঁর পথ আটকে বিক্ষোভ করেন আহত ব্যক্তিরা।
আহত ব্যক্তিদের বিক্ষোভের মধ্যে একপর্যায়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নিজের গাড়িতে উঠতে পারেননি। দুপুর সাড়ে ১২টার পর অন্য একটি গাড়িতে চড়ে হাসপাতাল থেকে চলে আসেন তিনি। এরপর রাস্তায় নেমে আসেন পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত ব্যক্তিরা। পরে পাশের জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন চোখে আঘাত পাওয়া ব্যক্তিরা সেখানে এসে আন্দোলনে যোগ দেন।
বেলা দুইটার পর আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে আহত মো. মাসুম হুইলচেয়ারে বসে বলেন, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা হাসপাতালের চতুর্থ তলায় গেলেও তাঁদের দেখতে তিনতলায় যাননি। উপদেষ্টা তিন মাস পর হাসপাতালে এসেছেন; কিন্তু আহত ব্যক্তিদের উপেক্ষা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের রক্তের ওপর দিয়ে তিনি উপদেষ্টা হয়েছেন।’ মাসুম আরও বলেন, জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে আহত ব্যক্তিদের এক লাখ টাকা করে দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো বেশির ভাগই তা হাতে পাননি।
পঙ্গু হাসপাতালের তৃতীয় তলায় চিকিৎসাধীন মো. শাওন। ৫ আগস্টে পুরান ঢাকার বংশালে তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। নিজেকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম উল্লেখ করে শাওন বলেন, তিনি আহত হওয়ার পর তিন মাস ধরে তাঁর সংসার চলছে কষ্টের মধ্য দিয়ে। বাসার আসবাব, রেফ্রিজারেটর ও টেলিভিশন বিক্রির টাকা দিয়ে এত দিন তাঁর সংসার চলছিল। তিনি আরও বলেন, এখন ছয় মাস বয়সী সন্তানকে দুধ কিনে খাওয়াতেও কষ্ট হচ্ছে। জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের টাকাটা পেলে খুব উপকার হতো।
শাওনের ভাষ্য, টাকা কবে পাওয়া যাবে, জানতে চাইলে তাঁদের বলা হয়, যাচাই-বাছাই চলছে; কিন্তু তা আর শেষ হচ্ছে না।
চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট থেকে রাস্তা অবরোধে আসা আল মিরাজ নামের এক আহত শিক্ষার্থী বলেন, গুলিতে তাঁর ডান চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন, এই দেশে তাঁর চিকিৎসা সম্ভব নয়। তাই তাঁকে বিদেশে পাঠিয়ে চিকিৎসা করানোর দাবি জানান তিনি। আল মিরাজ বলেন, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা পঙ্গু হাসপাতালে আহত ব্যক্তিদের খোঁজ নিতে এলেও তিনি গতকাল চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন চোখে আঘাত পাওয়া ব্যক্তিদের খোঁজ নিতে আসেননি।
এই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছে ডান চোখে গুলিবিদ্ধ তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. শাকিব (১২)। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের মাটিকাটা এলাকার বঙ্গ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী গত ১৯ জুলাই পরিবারকে না জানিয়ে ইসিবি চত্বরে মিছিল করতে গিয়েছিল। মিছিলে চোখে গুলি লাগে তার। অস্ত্রোপচার করেও ভালো হয়নি।
বিক্ষোভে শাকিবের সঙ্গে রয়েছে তার মা সাবিনা বেগম। আক্ষেপ করে সাবিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলে অপারেশনের পরও চোখে দেখতে পারতেছে না। দেশে ছেলের ভালো চিকিৎসা হচ্ছে না।’ তিনি তাঁর ছেলেকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর অনুরোধ জানান।
পঙ্গু হাসপাতাল চিকিৎসাধীন চা-দোকানি জসিম উদ্দিন। তাঁর বাঁ হাতে গুলি লেগেছে। সড়কে বিক্ষোভের মধ্যে জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গত ৫ আগস্ট গাজীপুরের সফিপুরে আনসার একাডেমির পাশে গুলিতে আহত হন তিনি। এরপর পরিবার নিয়ে তিনি রাজশাহীতে চলে যান। সেখানে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১০ দিন আগে তাঁকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
জসিম বলেন, আহত হওয়ার পর থেকে তাঁর পরিবারের কোনো আয় নেই। তিন মেয়ে নিয়ে সংসার আর চলছে না। এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা ঋণ করেছেন। তিনি বলেন, জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে টাকাটা তিনি পাননি। কিছু টাকা পেলে আপাতত পরিবার চলতে পারবে।
রাত ১১টার সময়ও বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছিলেন আহত ব্যক্তিরা। তাঁদের দাবিদাওয়া পূরণের বিষয়ে এখনো কোনো ঘোষণা আসেনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ রাত ৯টার দিকে ঘটনাস্থলে যান। তিনি আহত ব্যক্তিদের বলেন, তাঁদের দাবির বিষয়ে উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলে তিনি রাত ১০টার মধ্যেই জানাবেন।
সর্বশেষ স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের বরাত দিয়ে মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসা নিতে আসা বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে তাঁদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা চলছে। তাঁরা আশা করছেন আগামীকাল বৃহস্পতিবারের মধ্যে বিষয়টির সুরাহা হবে।