প্রীতির ‘জন্ম ও যোনির ইতিহাস’

অন্যের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বইয়ে প্রকাশ করা নিয়ে প্রশ্ন

জান্নাতুন নাঈম প্রীতির লেখা ‘জন্ম ও যোনির ইতিহাস’ বইয়ের প্রচ্ছদ
ছবি: সংগৃহীত

জান্নাতুন নাঈম প্রীতির ‘জন্ম ও যোনির ইতিহাস’ বইটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। একই সঙ্গে নিজের লেখা বইয়ে অন্যের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা প্রকাশ করা কতটা নৈতিক, কতটা আইনসিদ্ধ, সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে।

এবারের একুশে বইমেলায় বইটি আসার পরই শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। মেলার ১৪তম দিনে বইটি নিষিদ্ধ করে বইমেলার জন্য বাংলা একাডেমি গঠিত টাস্কফোর্স। টাস্কফোর্সের নির্দেশে ১৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলেই মেলার স্টল থেকে বইটি তুলে নেয় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নালন্দা।

সিদ্ধান্তটি সম্পর্কে টাস্কফোর্সের সভাপতি অসীম কুমার দে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, বইটিতে মেলার নীতিমালা পরিপন্থী নানা বিষয় উঠে এসেছে। তার মধ্যে ব্যক্তিগত আক্রমণ ও কয়েকজন পরিচিত ব্যক্তিকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য রয়েছে। এ বিষয়ে বইটির প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানও একমত হয়েছে।

মেলা থেকে তুলে নেওয়া হলেও বইটি এখন অনলাইনে অর্ডার করে পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাবাজারেও বইটি পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান নালন্দার স্বত্বাধিকারী রেদওয়ানুর রহমান।

লেখক প্রীতি এখন প্যারিস থাকেন। তিনি দেশের বাইরে বসে বইটি লিখেছেন। তাঁর নতুন এই বইয়ে নিজের ব্যক্তিগত জীবন উঠে এসেছে। পাশাপাশি দেশের বিনোদনজগতের কয়েকজন ‘সেলিব্রিটি’র ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তিনি কিছু ‘বিতর্কিত’ কথা বইয়ে বলেছেন। মূলত বিষয়টি নিয়েই আলোচনা-সমালোচনার সূত্রপাত।

এই প্রেক্ষাপটে অনুমতি ছাড়া অন্যের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিজের বইয়ে প্রকাশ, শোনা কথার ভিত্তিতে কারও যৌনজীবন সম্পর্কে বলা ঠিক কি না, তা নিয়ে কয়েকজন কথাসাহিত্যিকের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁদের সবার মতে, অনুমতি ছাড়া কারও যৌন সম্পর্কের কথা নিজের বইয়ে প্রকাশ করাটা অনুচিত। বিষয়টি শোভনও নয়। সে ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা চাইলে লেখকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। তবে মেলায় বইটি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন কেউ।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক প্রথম আলোকে বলেন, তিনি প্রীতির বইটি পড়েননি। কিছুদিন আগে বইয়ের নামটা শুনেছেন। তাই এই লেখক কী লিখেছেন, কীভাবে লিখেছেন, সে সম্পর্কে তিনি কিছু বলতে পারছেন না।

নিজের লেখালেখির অভিজ্ঞতার আলোকে আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, ‘আত্মজীবনী আমি নিজেও লিখেছি। সেখানে আমি আমার কথাই লিখেছি।’

বইয়ে অন্যের ব্যক্তিগত গোপনীয় বিষয় লিখতে হলে যাঁর সম্পর্কে লেখা হচ্ছে, অবশ্যই তাঁর অনুমতি নেওয়া উচিত বলে মতে দেন আনোয়ারা সৈয়দ হক। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেই ব্যক্তি যদি জীবিত না থাকেন, তাহলে তাঁর পরিবারের কাছ থেকে এই অনুমতি নিতে হবে। এটি একটি ভদ্রতা। কিন্তু বাংলাদেশে এসব কেউ মানে না। কেউ যদি নৈতিকতার বিষয়টি না মানে, তাহলে তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদও হয় না। সৈয়দ শামসুল হক সম্পর্কে অনেকেই আজেবাজে কথা লিখেছেন। তা নিয়েও কোনো প্রতিবাদ হয়নি।

কথাসাহিত্যিক নাসরীন জাহান বলেন, তিনি পুরো বইটি পড়েননি। তবে যতটুকু পড়েছেন, তাতে তাঁর মনে হয়েছে, যখন ঘটনাগুলো ঘটেছে বলে বলা হচ্ছে, তখন লেখক তা বলেননি বা প্রকাশ করেননি। তিনি দেশ ছাড়ার পর কথাগুলো বলেছেন। নিজের সঙ্গে যা ঘটেছে, তা যেমন তিনি লিখেছেন, তেমনি লেখককে বন্ধু ভেবে অন্যরা যেসব কথা বলেছেন, তা-ও তিনি উল্লেখ করেছেন। এখানে ধর্ষণের কোনো অভিযোগ নেই। তা ছাড়া অন্যের বলা কথা কতটুকু সত্য, তা লেখকের জানার কথা নয়। তাই এখানে সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে যায়। পৃথিবীর কেনো পাঠকই বিষয়টি সমর্থন করবেন না।

মেলায় বইটি নিষিদ্ধ করা প্রসঙ্গে নাসরীন জাহান বলেন, আয়োজক কমিটি নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছে। হয়তো এমন ব্যবস্থা আছে। কিংবা এ নিয়ে এমন নির্দেশ আছে। তবে মেলায় পাওয়া না গেলেও অন্য জায়গা থেকে পাঠক বইটি কিনতে পারছেন।

কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক শাহনাজ মুন্নী বলেন, নৈতিকভাবেই বইটি প্রকাশ করা উচিত হয়নি। কারও ব্যক্তিগত কথা প্রকাশ করতে চাইলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অনুমতি নিতে হবে। লেখক তাঁর বইয়ে অন্যের ব্যক্তিগত গোপনীয় কথা প্রকাশ করেছেন। এতে অন্যের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। যে ব্যক্তিদের নিয়ে লেখা হয়েছে, তাঁদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। আর লেখকের সঙ্গে অন্যদের যে সম্পর্ক হয়েছে, তা অলিখিত চুক্তির মাধ্যমেই হয়েছে। সমাজে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। তবে বইটিতে যেভাবে লেখা হয়েছে, তাতে মূল্যবোধের জায়গাটিও নড়বড়ে হয়ে গেছে।

শাহনাজ মুন্নী আরও বলেন, বইটির লেখক অন্যদের অনুমতি নিয়েছিলেন কি না, লেখক কোন উদ্দেশ্যে লিখেছেন, সে সম্পর্কে তিনি এখন পর্যন্ত কিছু বলেননি। একইভাবে যাঁদের সম্পর্কে লিখেছেন, তাঁরাও সেভাবে প্রতিবাদ করেননি, নিজেদের মতামত জানাননি। মূলত ফেসবুকসহ বিভিন্ন জায়গায় অন্যরাই বেশি বইটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করছেন। তবে বইটি মেলায় নিষিদ্ধ করা ঠিক হয়নি। কারণ, তিনি কোনো বই নিষিদ্ধের পক্ষে না।

ফেসবুকে আলোচনা-সমালোচনা

কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক আহমাদ মোস্তফা কামাল ফেসবুকে লিখেছেন, ‘যখন আপনি কারও সঙ্গে সম্পর্কিত হন, তখন আপনাদের দুজনের একান্ত স্মৃতি এবং গোপনীয়তা কেবল আপনার একার ব্যক্তিগত নয়, যৌথভাবে দুজনেরই ব্যক্তিগত। আপনার সঙ্গীর অনুমোদন ছাড়া সেই যৌথ গোপনীয়তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা অনৈতিক, এমনকি সেই সঙ্গী প্রাক্তন হয়ে গেলেও।’

কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান লিখেছেন, ‘কোনো নরনারী যদি পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে যৌনানন্দ উপভোগ করে, তাতে দোষের কিছু নেই। তাতে সমাজ ধসে যায় না, সভ্যতা ধসে যায় না। যৌনতা ব্যক্তির ব্যক্তিগত প্রয়োজন। এই প্রয়োজনীয় কর্মটি মানুষ গোপনেই সারে। এটা প্রচারের বিষয় নয়। এসব যে প্রচারের বিষয় নয়, তা রুচিসম্পন্ন, সভ্য মানুষেরা বুঝতে পারেন। পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে, বিশ্বাসের ভিত্তিতে, গোপনীয়তার শর্তে যৌনানন্দ উপভোগের পর নর বা নারী কেউ যদি সেসব গোপন কথা পরবর্তীকালে মৌখিক বা লেখ্যরূপে প্রচার করে বেড়ায়, তাহলে বুঝতে হবে তার অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে।’

যুক্তরাষ্ট্রের বার্ড কলেজের ভিজিটিং প্রফেসর ফাহমিদুল হক ‘(অ)প্রীতিকর বিতর্ক’ শিরোনামে ফেসবুকে একটি দীর্ঘ পোস্ট দিয়েছেন। তিনি একটি অংশে লিখেছেন, ‘যৌনতা নিয়ে প্রীতির যে দর্শন, তা নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই, এ তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে “বিখ্যাত” লোকগুলো সম্পর্কে সে যা যা লিখেছে, তার কতকগুলো দিক নিয়ে আমার অনাপত্তি থাকলেও, কতকগুলো দিক নিয়ে অবজারভেশন বা আপত্তি আছে।’

লেখক, গবেষক, চলচ্চিত্র-গণমাধ্যম সমালোচক ফাহমিদুল হক তাঁর পোস্টের শেষাংশে লিখেছেন, ‘তবে সবচেয়ে বড় কথা, কোনো বিচারেই একটা বই নিষিদ্ধ হতে পারে না। কোনো বিচারেই না। একটি বইয়ে যদি “ক্ষতিকর” উপাদান থাকে বলে মনে হয়, তবে তাকে কনডেম করা যাবে, বকাঝকা করা যাবে, আরও লেখালেখি করা যাবে তা নিয়ে, কিন্তু সীমিত আকারে হলেও, নিষিদ্ধ করা যাবে না।’