সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলে গ্যাসের দাম জানুয়ারিতে বাড়ানো হয়েছিল রেকর্ড হারে। এখন শুরু হয়েছে গ্যাস–সংকট।
বাড়তি দাম দিয়ে হলেও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ চেয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। সরকারও বাড়তি গ্যাস কেনার টাকা জোগাড় করতে শিল্পে দাম বাড়িয়েছিল ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, গ্যাসের অভাবে কারখানা পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না।
বাড়তি দাম দিয়েও প্রয়োজনীয় গ্যাস না পেয়ে হতাশ ব্যবসায়ীরা। যেমন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের দুটি সংগঠনের একটি বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায়ীরা তিতাসকে অতিরিক্ত দাম দিয়েও এখন গ্যাস পাচ্ছেন না।
এভাবে চলতে থাকলে দেশে উৎপাদন না করে বিদেশ থেকে কাপড় আমদানি করা ছাড়া উপায় থাকবে না। এতে আমদানিনির্ভরতা বাড়বে, ডলার–সংকট আরও বেড়ে যাবে।
মার্কিন ডলার সাশ্রয়ের জন্য গত বছর জুলাই থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ রেখেছিল সরকার। তখন গ্যাস–সংকট বেড়ে যায়। এতে ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে গ্যাস সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করার দাবি জানান।
গ্যাসের নতুন সংকট শুরু হয়েছে সপ্তাহখানেক ধরে। গ্যাস সরবরাহকারী সরকারি সংস্থাগুলো বলছে, এই সংকট তিন কারণে—১. দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন কমেছে। ২. শিল্প খাতে কমিয়ে সরকারি সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ করতে হচ্ছে। ৩. হঠাৎ কমেছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র বলছে, দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। কয়েক দিন ধরে গড়ে সরবরাহ করা হচ্ছে ২৬৫ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে এলএনজি থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে দিনে ৬০ কোটি ঘনফুট। যদিও দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে দৈনিক ৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের কথা।
মার্কিন ডলার সাশ্রয়ের জন্য গত বছর জুলাই থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ রেখেছিল সরকার। তখন গ্যাস–সংকট বেড়ে যায়। এতে ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে গ্যাস সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করার দাবি জানান। প্রয়োজনে দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রেও সম্মতি দেন।
সরকার গত জানুয়ারিতে গ্যাসের দাম গড়ে ৮০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়, যা ছিল দেশের ইতিহাসে একসঙ্গে সর্বোচ্চ মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা। তখন শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত। দাম বাড়ানোর পর ফেব্রুয়ারি থেকে খোলাবাজারের এলএনজি কেনা শুরু করে সরকার। তাই সরবরাহ মোটামুটি স্বাভাবিক ছিল। এখন আবার সংকট বাড়ল।
তিতাস বলছে, গতকাল জয়দেবপুরের আওতায় চন্দ্রা, টঙ্গী, জয়দেবপুরসহ আশপাশের ৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা ছিল। সরবরাহ করা হয়েছে ৩৫ থেকে ৩৬ কোটি ঘনফুট।
২০১৮ সাল থেকে দেশে গ্যাস আমদানি শুরু হয়, যা এলএনজি নামে পরিচিতি। বাংলাদেশে দুইভাবে এলএনজি কেনে—ওমান ও কাতারের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এবং খোলাবাজার থেকে। খোলাবাজারে দাম কার্যত বেশি থাকে।
দেশে এলএনজি আমদানি করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল)। তারা সাধারণত শীত সামনে রেখে নভেম্বর থেকে খোলাবাজারের এলএনজি আনা কমিয়ে দেয়। কারণ, এ সময় বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে বলে ওই খাতে গ্যাসও কম লাগে। এবার নভেম্বর ও ডিসেম্বরে খোলাবাজারের এলএনজি আমদানির কোনো পরিকল্পনা ছিল না।
আরপিজিসিএল সূত্র বলছে, সংকট দেখা দেওয়ায় আগামী দুই মাসে তিন থেকে চারটি এলএনজিবাহী কার্গো আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সমস্যা হলো দুটি এলএনজি টার্মিনালের একটির রক্ষণাবেক্ষণের সময় এসে গেছে। সেটি বন্ধ রাখা হলে সংকট বাড়বে।
দুটি টার্মিনালের একটি সামিট গ্রুপ, অন্যটি মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি পরিচালনা করে। প্রতি পাঁচ বছরে একবার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য টার্মিনাল বন্ধ রাখতে হয়। গত এপ্রিলে এক্সিলারেটের টার্মিনালটি রক্ষণাবেক্ষণের কথা ছিল। ওই সময় গ্যাসের চাহিদা বেশি থাকায় রক্ষণাবেক্ষণ পিছিয়ে দেওয়া হয়। এখন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১ নভেম্বর থেকে টার্মিনালটি পুরোপুরি বন্ধ করার কথা। এতে সরবরাহ আরও কমবে।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গ্যাস–সংকট নিয়ে চাপ তৈরি হতে পারে। তাই টার্মিনাল এখন বন্ধ হোক, তা চায় না সরকার। পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিচালন) কামরুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, এলএনজি টার্মিনাল এখনই বন্ধ না করে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ পিছিয়ে আগামী বছরে নেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। যদিও সূত্র বলছে, রক্ষণাবেক্ষণ পেছানোর বিষয়টি এখনো নিশ্চিত করেনি এক্সিলারেট। রক্ষণাবেক্ষণ না করলে হঠাৎ যদি টার্মিনাল বিকল হয়ে যায়, তাহলে আরও বাজে পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা থাকে।
দেশে বর্তমানে ২৮টি গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে সাধারণত দিনে ২২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়, যা এখন ১৫ কোটি ঘনফুটের মতো কমেছে। গতকাল বুধবার দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে সরবরাহ করা হয়েছে ২০৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস।
দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন করার জন্য বিশেষজ্ঞরা জ্বালানি বিভাগের অবহেলা ও অদক্ষতাকে দায়ী করেন। তাঁরা বলছেন, কারিগরি পরিকল্পনা ও দক্ষ প্রযুক্তির অভাবে মজুত থাকার পরও উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। পেট্রোবাংলার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন কমেছে। এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস বেশি দিতে হচ্ছে। সার কারখানায় সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। তাই শিল্প এখন বেশি ভুগছে।
শিল্পকারখানায় নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র (ক্যাপটিভ) ও বয়লার চালাতে গ্যাস দরকার হয়। গ্যাস না পেলে তাদের উচ্চমূল্যের ডিজেল ব্যবহার করতে হয়। শিল্পকারখানাগুলোর মালিকেরা বলছেন, গ্যাস–সংকটের কারণে তাঁরা বিপাকে পড়েছেন।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মঈন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের চাপ অনেক কম, এ দিয়ে কারখানা চালানো যাচ্ছে না।
কালিয়াকৈরে উপজেলার সাদমা ফ্যাশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি নাছির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস–সংকটের কারণে কারখানার উৎপাদন অনেক কমে এসেছে। গাজীপুরের বেশির ভাগ কারখানায় একই অবস্থা।
তিতাস বলছে, গতকাল জয়দেবপুরের আওতায় চন্দ্রা, টঙ্গী, জয়দেবপুরসহ আশপাশের ৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা ছিল। সরবরাহ করা হয়েছে ৩৫ থেকে ৩৬ কোটি ঘনফুট। তিতাসের গাজীপুর শাখার উপমহাব্যবস্থাপক শাহজাদা ফরাজী বলেন, প্রতিদিনই শিল্পকারখানার মালিকদের অভিযোগ আসছে।
নারায়ণগঞ্জ শিল্পাঞ্চলে গ্যাসের চাপ বাড়ানোর দাবি জানিয়ে তিতাস গ্যাস নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়কে ২৩ অক্টোবর চিঠি দিয়েছেন ডাইং ও পোশাক কারখানার মালিকেরা।
বাসাবাড়িতে গ্যাস–সংকটের কথা জানাতে তিতাসে গ্রাহকের ফোন বেড়েছে। বেশি ফোন আসছে মোহাম্মদপুর, মিরপুর, পাইকপাড়া, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, পুরান ঢাকা ও কল্যাণপুর থেকে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, সরকার ইচ্ছেমতো দাম বাড়াল, কিন্তু কথামতো সরবরাহ না করে গ্যাস–সংকটে রাখা হচ্ছে। সরকারের এই আচরণ অসাধু ব্যবসায়ীদের মতো।
[প্রতিবেদনে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর ও প্রতিনিধি, নারায়ণগঞ্জ]