আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) শুনানিতে বাংলাদেশের পক্ষে যুক্তিতর্ক তুলে ধরেন নেদারল্যান্ডসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ
আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) শুনানিতে বাংলাদেশের পক্ষে যুক্তিতর্ক তুলে ধরেন নেদারল্যান্ডসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ

আইসিজেতে বাংলাদেশ

আত্মরক্ষার নামে ইসরায়েল যা করছে, তা যৌক্তিক নয়

ইসরায়েল আত্মরক্ষার নাম করে ফিলিস্তিনের গাজায় যা করছে, তা যৌক্তিক নয়। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের দখলদারত্ব আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। সেখানে শিশুসহ হাজার হাজার বেসামরিক মানুষকে হত্যা, বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া, খাবার সরবরাহে বাধাদান জাতিগত নিধনের উদাহরণ। দখলদারত্ব অবসানে অবশ্যই ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার করতে হবে ও দখল করা ভূমিতে নির্মিত অবৈধ স্থাপনা ধ্বংস করতে হবে।

ইসরায়েলের দখল করা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড নিয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) শুনানিতে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ এসব কথা বলেছে। মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনের শুনানিতে বাংলাদেশসহ ১০টি দেশ অংশ নেয়।

গত সোমবার নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে অবস্থিত জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালতে এ শুনানি শুরু হয়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হওয়া এ শুনানিতে পর্যায়ক্রমে ৫০টির বেশি দেশ ও ৩টি সংগঠনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করার কথা রয়েছে। শুনানি চলবে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এ শুনানির সঙ্গে গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার অভিযোগে আইসিজেতে করা দক্ষিণ আফ্রিকার মামলার যোগসূত্র নেই।

গতকালের শুনানিতে বাংলাদেশের পক্ষে যুক্তিতর্ক তুলে ধরেন নেদারল্যান্ডসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ। তিনি বলেন, ইসরায়েল অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে শিশুসহ হাজার হাজার বেসামরিক লোকজনকে হত্যা, তাদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া, খাবার ও পানি সরবরাহে বাধাদান জাতিগত নিধনের উদাহরণ। ওই এলাকায় ইসরায়েলি দখলদারত্বের অবসানে জাতিসংঘের আরও পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। এর পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের জাতিবিদ্বেষ বন্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে।

কোন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ আইসিজের শুনানিতে অংশ নিচ্ছে, সেই প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ। বিশেষ করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের সাংবিধানিক ও আইনি অবস্থানের বিষয়গুলো উপস্থাপন করেন তিনি।

রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, গাজায় ইসরায়েলের চলমান অভিযান আধুনিককালের লজ্জাকর বিপর্যয়ের দৃষ্টান্ত। খাদ্য, পানি, জ্বালানি ও ওষুধের ঘাটতি প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকায় ২৩ লাখ মানুষের ওই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা সৃষ্টি করছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও অন্য মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলো এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে।

পরিস্থিতির উত্তরণে ইসরায়েল এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পদক্ষেপের বিষয়ে সুস্পষ্ট করে কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, বৈষম্যমূলক আইনে সই ও পদক্ষেপ নেওয়া বন্ধসহ ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারে বাধা সৃষ্টি করে এমন কর্মকাণ্ড থেকে ইসরায়েলকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। ইসরায়েলকে অবশ্যই তাদের সেনা প্রত্যাহারের পাশাপাশি দখলকৃত এলাকার সব অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দিতে হবে। তিনি বলেন, ফিলিস্তিনি জানমালের ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং ক্ষতিকর কোনো কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি হবে না—সে নিশ্চয়তাও দিতে হবে। সব রাষ্ট্রকে অবশ্যই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য যেকোনো আইনি প্রতিবন্ধকতার অবসান নিশ্চিত করতে হবে এবং বল প্রয়োগ করে ভূখণ্ড অধিগ্রহণের নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে হবে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বলেন, পূর্ব জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের অন্যায় কাজকে রাষ্ট্রগুলোর স্বীকৃতি দেওয়া বা সহায়তা দেওয়া উচিত হবে না। ইসরায়েল যাতে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলে, তা নিশ্চিত করার স্বার্থে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সহযোগিতা অপরিহার্য। তিনি আরও বলেন, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের দখলদারত্বের অবসান ঘটাতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আরও পদক্ষেপ বিবেচনা করা উচিত। জাতিবিদ্বেষের অবসান ঘটানোর জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়াও জরুরি।

ফিলিস্তিনিরা চরম জাতিবিদ্বেষের শিকার

গতকালের শুনানির শুরুতে যুক্তিতর্ক তুলে ধরে দক্ষিণ আফ্রিকা। নেদারল্যান্ডসে নিযুক্ত দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত ভুসিমুজি ম্যাডোনেসলা বলেন, ১৯৯৪ সালের আগে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ যেভাবে বর্ণ ও জাতিবিদ্বেষের শিকার হয়েছেন, তার চেয়েও চরম মাত্রায় বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা।

ভুসিমুজি ম্যাডোনেসলা বলেন, ‘আমরা দক্ষিণ আফ্রিকান হিসেবে (ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে) ইসরায়েলের অমানবিক বৈষম্যমূলক নীতি ও পদক্ষেপগুলো আরও গভীরভাবে অনুভব করতে পারি। আমার দেশের কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে যে বৈষম্যকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছিল, ফিলিস্তিনিরা তার চেয়েও চরমমাত্রার বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।’ ভুসিমুজি আরও বলেন, ইসরায়েলি জাতিবিদ্বেষের অবশ্যই অবসান ঘটাতে হবে।

ইসরায়েলকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে

সৌদি আরবের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন নেদারল্যান্ডসে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত জিয়াদ আল-আতিয়াহ। তিনি বলেন, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে। এ জন্য ইসরায়েলকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

জিয়াদ আল-আতিয়াহ বলেন, ফিলিস্তিনিদের মানুষরূপে গণ্য করে না ইসরায়েল। ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে এমন আচরণ করছে, তারা ‘যেন একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়ার বস্তু’।

সৌদি রাষ্ট্রদূত বলেন, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অবৈধ বসতি সম্প্রসারণ ও ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের মাধ্যমে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে অসম্ভব করে তুলছে ইসরায়েল।
সোমবারের শুনানি শুরুর দিনে শুধু ফিলিস্তিন আদালতে যুক্তি উপস্থাপন করে। গতকাল বাংলাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা ও সৌদি আরব ছাড়াও যুক্তি তুলে ধরেন আলজেরিয়া, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, চিলি, বেলিজ, বলিভিয়া ও ব্রাজিলের প্রতিনিধিরা। গতকাল কানাডার পক্ষ থেকেও যুক্তি উপস্থাপনের কথা ছিল। তবে শেষ মুহূর্তে জানানো হয়, দেশটি শুনানিতে অংশ নেবে না।

ইসরায়েলের দখলদারত্ব, অবৈধ বসতি স্থাপন ও ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে ইসরায়েলি ভূখণ্ডের সঙ্গে একীভূত করার অপতৎপরতা পর্যালোচনা করতে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আইসিজের প্রতি শুনানির আহ্বান জানিয়েছিল জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ। তাতে ইসরায়েলের দখলে থাকা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড নিয়ে আইসিজের নির্দেশনা ও মতামত চাওয়া হয়েছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই শুনানি শুরু হয়। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর চলমান হামলায় ২৯ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার মধ্যেই আইসিজেতে এ শুনানি চলছে।