ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় ব্লাস্ট ও প্রথম আলো যৌথভাবে এ বৈঠকের আয়োজন করে।
দলিত, সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ও ট্রান্সজেন্ডারের মতো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা এখনো সমাজে নানাভাবে পিছিয়ে রয়েছেন। কেবল তা–ই নয়, এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা কত, তারও সঠিক হিসাব নেই। সঠিক পরিসংখ্যানের অভাবে তাঁদের উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায় না। এ কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জাতীয় তথ্যভান্ডার প্রবর্তন করা প্রয়োজন।
‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আইনি ও সামাজিক সুরক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব বিষয় উঠে এসেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও প্রথম আলো যৌথভাবে গতকাল সোমবার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে এই বৈঠকের আয়োজন করে।
এই গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি এম এ মান্নান। শুধু দলিতদের নিয়ে একটি সংসদীয় ককাস হচ্ছে জানিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে এম এ মান্নান বলেন, দলিত মানুষদের মধ্যেও কেউ কেউ ব্যবসা–বাণিজ্য করে এগিয়ে যাচ্ছেন; কিন্তু বেশির ভাগ দলিত মানুষ শিক্ষাবিহীন, চিকিৎসাবিহীন, গৃহবিহীন। তাঁদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
এম এ মান্নান বলেন, নিজেদের অধিকার আদায়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর তরুণেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কাজে লাগাতে পারেন। দেশে যতটা অন্যায় ও বৈষম্য কমানো যায়, তার ওপর জোর দেন তিনি।
আগামী সংসদ অধিবেশনে বৈষম্যবিরোধী আইন নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করবেন বলে জানান বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন। নতুন সংসদ সদস্যদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিষয়ে আরও সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
সম্প্রতি ঢাকার বংশাল থানার মিরনজিল্লা পল্লিতে হরিজন সম্প্রদায়কে উচ্ছেদ ও তাঁদের ওপর হামলা প্রসঙ্গে রাশেদ খান মেনন বলেন, দলিতদের উচ্ছেদের আগে পুনর্বাসনের কথা বলা হলেও পরে তা ঠিকমতো হয় না। প্রায় একই ঘটনা মিরনজিল্লায় ঘটছে। সংসদ সদস্য, মেয়র ও কাউন্সিলরদের এসব বিষয়ে আরও সংবেদনশীল হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। সেই সঙ্গে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিষয়ে সরকারের যেসব নীতি রয়েছে, সেসব বিষয়ে জনপ্রতিনিধিদের অবহিত হওয়ার আহ্বান জানান রাশেদ খান মেনন।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। তিনি বলেন, কাউকে পেছনে রেখে একটি সমাজ এগিয়ে যেতে পারেন না। তাই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর বিশেষ জোর দেওয়া উচিত।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য বৈষম্যবিরোধী আইনের মতো নতুন আইনের দরকার বলে মনে করেন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক আইনজীবী সারা হোসেন। তিনি বলেন, কোনো কোনো আইনে কিছু পরিবর্তন দরকার এবং আইনগুলো প্রয়োগের ক্ষেত্রে কী হচ্ছে, তা নজরদারির প্রয়োজন আছে।
সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করে ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর নুজহাত জাবিন বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। তাঁরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জানেন না। আবার কোথায় গেলে তাঁরা সেবা পাবেন, তা–ও জানেন না। পাশাপাশি সেবা প্রদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে প্রান্তিক মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করবে, তাঁদের যে আলাদা কিছু দেবে, সেই জায়গায়গুলো চিহ্নিত করতে পারে না। এই সচেতনতা তৈরির ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ভূমি ও শিক্ষা—এই দুটি অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করেন রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মেঘনা গুহঠাকুরতা। তিনি বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই দুটি অধিকার নিশ্চিত করতে পারলে জীবিকা ও সম্মানের মতো অন্যান্য অধিকার তাঁদের পক্ষে অর্জন করা সহজ হয়ে যায়। মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, কিছু মানুষ এতটাই প্রান্তিক হয়ে গেছেন যে তাঁরা শ্মশানঘাট পর্যন্ত রক্ষা করতে পারছেন না।
নাগরিক উদ্যোগের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক নাদিরা পারভীন বলেন, পেশা ও বংশপরিচয়ের কারণে দলিত মানুষেরা বৈষম্যের শিকার হন। হাসপাতালে গেলে চিকিৎসকেরা তাঁদের হাত দিয়ে স্পর্শ করতে চান না। কিছু বিদ্যালয়ে দলিত শিক্ষার্থীদের দিয়ে শৌচাগার পরিষ্কার করানো হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ক্লাসের পেছনের দিকে বেঞ্চে তাদের বসতে দেওয়া হয়। এসব দূর করতে বৈষম্য বিলোপ আইন করা জরুরি বলেও মনে করেন তিনি।
দলিত, সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ও ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর সঠিক পরিসংখ্যান দরকার বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মী ইলিরা দেওয়ান। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নিয়ে কোনো একটা পরিকল্পনা করতে গেলে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় প্রকৃত পরিসংখ্যান না থাকায়। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অনেকে বাংলায় লিখতে ও পড়তে পারলেও তাঁদের মাতৃভাষায় লিখতে ও পড়তে পারেন না। কোটা না থাকলে হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেতেন না বলেও উল্লেখ করেন ইলিরা দেওয়ান।
গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্লাস্টের সোশ্যাল জাস্টিস অ্যান্ড ইনস্টিটিউশন ক্লাস্টারের উপদেষ্টা আহমদ ইব্রাহিম। তিনি বলেন, একটি অধিকারকেন্দ্রিক, সূক্ষ্ম ও বিস্তৃত জাতীয় তথ্যভান্ডার প্রবর্তন করা দরকার, যা উক্ত জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার সূচককে এবং অগ্রগতির মূল্যায়নকে কার্যকরভাবে প্রতিফলিত করবে।
দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব ভাষা হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের জাতীয় কমিটির সদস্য হেলেনা তালাং। সেই সঙ্গে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা বাংলায় পড়াশোনা করতে গিয়ে যে সমস্যায় পড়ছে, তা-ও তুলে ধরেন হেলেনা তালাং। তিনি সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ভূমি কমিশন গঠনের দাবি জানান।
ব্লাস্টের সহযোগী আউটরিচ অফিসার শোভা সরকার বলেন, প্রকৃতির নিয়মেই একজন ট্রান্সজেন্ডার হন, যা সবার বোঝা উচিত। এ বিষয়ে সচেতনতা প্রয়োজন।
প্রতিবন্ধীদের জন্য যেসব আইন ও নীতিমালা আছে, সেসব জায়গায় স্পাইনাল কর্ডে আক্রান্ত হওয়া প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্তি করা দরকার বলে মনে করেন উইমেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিস ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন অফিসার উজ্জল মাহমুদ।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।