রাজশাহীতে ‘যক্ষ্মা চিকিৎসায় বেসরকারি খাতের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে শনাক্তের বাইরে থাকা যক্ষ্মা রোগীদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সমাজের এলিট শ্রেণির মানুষ, হতদরিদ্র মানুষ, দুর্গম চর এলাকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠী, কারাগার, কারখানায় কাজ করেন, এমন মানুষদের কাছে চিকিৎসাসেবা পৌঁছানো যায় না। একশ্রেণির মানুষ গোপন করেন, আরেক শ্রেণির মানুষ চিকিৎসাসেবার বাইরে থাকেন। অথচ তাঁরা অন্য ব্যক্তিদের মধ্যে অনবরত যক্ষ্মার জীবাণু ছড়িয়ে যাচ্ছেন। এই ক্ষেত্রে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচার এবং প্রচারই শেষ কথা নয়, হতদরিদ্র মানুষের আয়রোজগারের বিষয়টিও আলোচনায় উঠে এসেছে।
স্টপটিবি পার্টনারশিপের সহযোগিতায় যৌথভাবে আয়োজন করে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও প্রথম আলোর আয়োজনে গত ১৯ অক্টোবর রাজশাহী নগরের একটি রেস্তোরাঁয় এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কর্মরত চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী। সম্মানিত অতিথি ছিলেন রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক আনোয়ারুল কবীর, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. জহিরুল হক, জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (এনটিপি) রাজশাহী বিভাগীয় যক্ষ্মাবিশেষজ্ঞ মো. সাইফুল ইসলাম, বারিন্দ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক সমীর মজুমদার, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. আবদুস সালাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক কাজী শুসমিন আফসানা, রাজশাহী তিলোত্তমার পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন কর্মকর্তা খাদিজাতুল কোবরা, ব্র্যাকের রাজশাহী বিভাগীয় ব্যবস্থাপক মো. সাইফুল ইসলাম, ইবনে সিনা ট্রাস্টের রাজশাহী করপোরেট শাখার কর্মকর্তা মাসুদ রানা। গণমাধ্যম প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দৈনিক সোনার দেশ পত্রিকার সম্পাদক আকবারুল হাসান মিল্লাত ও দৈনিক রাজশাহীর সংবাদ–এর সম্পাদক আহসান হাবীব অপু। অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর রাজশাহীর নিজস্ব প্রতিবেদক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল-বারিন্দর অধ্যাপক সমীর কুমার মজুমদার বলেন, বেসরকারি খাতে যাঁরা যক্ষ্মা চিকিৎসার জন্য যান, তাঁদের হিসাবটা সব সময় পাওয়া যায় না। এটা না পাওয়া গেলে সঠিকভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যায় না। তিনি এক পরিসংখ্যান থেকে বলেন, বিশ্বের ৩০টি দেশ যক্ষ্মা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬ নম্বরে। তিনি আরেকটি বিষয়ে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন যে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলে বিদেশি সাহায্য আর পাওয়া যাবে না। সেই ক্ষেত্রে চিকিৎসায় নিজেদের সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে।
তিলোত্তমা-রাজশাহীর পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন কর্মকর্তা ডা. খাদিজাতুল কোবরা বলেন, তাঁরা সিটি করপোরেশনের ১০টি ওয়ার্ডে কাজ করেন। প্রয়োজনে বাসায় গিয়ে নমুনা নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। রোগ নিশ্চিত হলে বিনা মূল্যে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। চিকিৎসা শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা ইতিবাচকভাবে রোগীকে বুঝিয়ে তাঁদের কেন্দ্রে নিয়ে আসেন এবং চিকিৎসা চালিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। নগরের ঘোষপাড়ার মোড়ে ব্র্যাক সেন্টার, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ডট সেন্টার, আইডিডিআরবি রয়েছে, তাদের সহযোগিতায় এগুলো করা হয়। তিনি বলেন, তাঁদের স্বেচ্ছাসেবীরা দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে কাজ করেন। এ ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তের সহযোগিতা পেলেও এলিট শ্রেণির ক্ষেত্রে বাধা আসে। তারা বাসায় ঢোকার অনুমতি দেন না। এই ক্ষেত্রে তাদের যে ভূমিকাটি রয়েছে, প্রাইভেট সেক্টরের চিকিৎসকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে সম্পর্কটা বাড়ানো যায়, দেখা সাক্ষাৎটা বেশি করা যায় তাহলে মিসিং কেসগুলো চিকিৎসার অধীনে আসবে। কারণ, প্রাইভেট সেক্টরের চিকিৎসকদের রেফারেন্সটা কাজে লাগানো যাবে। এগুলো প্রতিবেদনের মধ্যে নিয়ে আসা যাবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক কাজী শুসমিন আফসানা বলেন, উন্নয়ন থিয়েটারের মাধ্যমে যক্ষ্মা বিষয়ে সচেতনতামূলক ছোট ছোট নাটক তৈরি করে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় দেখানো যেতে পারে। এনজিওগুলো এ ব্যাপারে সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে।
ব্র্যাকের রাজশাহী বিভাগীয় ব্যবস্থাপক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, তাঁরা দেশের ৫১টি জেলায় যক্ষ্মা নিয়ে সরাসরি করেন আর বাকি ১৩টি জেলায় অন্যদের সহযোগিতায় কাজ করেন। তিনি বলেন, ২০২২ সালের দেশে যক্ষ্মার ৩০ শতাংশ রোগী মিসিং ছিল। যা ২০২৩ সালে ২০ শতাংশে নামিয়ে এনেছেন। তাঁরাই যদি জীবাণু ছড়িয়ে যেতে থাকেন। ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। তিনি বলেন, বারিন্দ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডট সেন্টার করার জন্য তাঁরা চিঠি প্রস্তুত করেছেন। সেখানে তাঁদের শুধু একটা কক্ষের দরকার পড়বে। তিনি বলেন, তাঁরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে পোর্টেবল এক্স–রে মেশিনে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষের এক্স–রে করে যক্ষ্মা শনাক্ত করছেন। তিনি বলেন, তাঁদের প্রতিনিধিরা কোনো বেসরকারি হাসপাতালে গেলে চিকিৎসকদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষ কথা বলার সুযোগ দিতে চান না। এ ব্যাপারে তাঁরা সহযোগিতা কামনা করেন।
ইবনে সিনার করপোরেট শাখার কর্মকর্তা মাসুদ রানা এ ব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
রাজশাহীতে বৈঠকের শুরুতেই আইসিডিডিআরবির সিনিয়র রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর ডা. আদিল সিকদার ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন।
অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে সমাপনী বক্তব্য দেন আইসিডিডিআরবির এসিটিবির চিফ অব পার্টি ডা. অং ক্য জাই মগ।