দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে উঠেছে রাজধানীর শাহবাগে। হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্বে বিএসএমএমইউ।
প্রযুক্তিনির্ভর অত্যাধুনিক চিকিৎসাসেবা দিতে ‘সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল’ উদ্বোধনের আট মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কর্তৃপক্ষ বিশেষায়িত এই হাসপাতাল পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা তো দূরের কথা, একজন রোগীও ভর্তি করতে পারেনি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিএসএমএমইউ সূত্র জানিয়েছে, বিশেষায়িত এই হাসপাতাল চালু করার জন্য মে মাসে উচ্চপর্যায়ের অন্তত চারটি সভা হয়েছে। হাসপাতালের একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগের সিদ্ধান্তও হয়েছে। ১ জুলাইয়ের মধ্যে হাসপাতাল চালু করতে বলা হয়েছে। এখন চাপে পড়ে জোড়াতালি দিয়ে হাসপাতালটি চালুর চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ।
দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে উঠেছে রাজধানীর শাহবাগের বিএসএমএমইউর কেবিন ব্লক ও সি ব্লকের উত্তর এবং ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের পশ্চিম দিকে।
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নত সেবা দেওয়া নতুন এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। রোগীর রক্তের নমুনা ল্যাবরেটরিতে যাবে যন্ত্রের মাধ্যমে, নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট চলে আসবে চিকিৎসকের কম্পিউটারে।অধ্যাপক মো. জুলফিকার রহমান খান, সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক
অবকাঠামো নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি কেনা বাবদ খরচ হয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৭ কোটি টাকা দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের ঋণ। ৩৩৮ কোটি টাকা সরকারের সহায়তা এবং বাকি ১৭৫ কোটি টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়ন।
বিএসএমএমইউতে প্রতিদিন পাঁচ হাজারের বেশি রোগী এর বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন। দেড় হাজার শয্যার হাসপাতালে ৪৬টি বিষয়ে বিশেষায়িত চিকিৎসা ও সেবা দেওয়া হয়। এত বড় আয়োজন থাকার পরও সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ আছে।
অভিযোগ উঠেছে, প্রযুক্তিনির্ভর অত্যাধুনিক চিকিৎসাসেবার যে কথা শোনানো হয়েছিল, বর্তমান বিএসএমএমইউর প্রশাসন তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না।
৩০ মে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক মো. জুলফিকার রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নত সেবা দেওয়া নতুন এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। রোগীর রক্তের নমুনা ল্যাবরেটরিতে যাবে যন্ত্রের মাধ্যমে, নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট চলে আসবে চিকিৎসকের কম্পিউটারে। প্রতিটি অপারেশন থিয়েটারের অপারেশন লাইটের সঙ্গে ক্যামেরা যুক্ত আছে। অপারেশনের সময় কেউ ভুল করলে তা যেমন ধরা পড়বে, অন্য দিকে শিক্ষার্থীরা অপারেশন থিয়েটারের বাইরে থেকে তা দেখাতেও পারবেন।
‘এ মাসে হাসপাতাল চালু করার চেষ্টা করব।’ জনবলের ব্যাপারে তিনি বলেন, বিএসএমএমইউ থেকে লোক এনে আপাতত কাজ চালাবেন। প্রয়োজনে যন্ত্রপাতি বিএসএমএমইউ থেকেও আনবেন।মো. শারফুদ্দিন আহমেদ, বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক
প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, এক ঘণ্টায় পাঁচ হাজার কাপড় ধোয়ার যন্ত্র আছে। প্রতি ঘণ্টায় ৪০ কেজি চিকিৎসাবর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা আছে। ২০০ গাড়ি রাখা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য আছে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। আছে জীবাণুমুক্তকরণের অত্যাধুনিক ব্যবস্থা। এসব করতে হাসপাতালের জন্য প্রায় তিন হাজার ধরনের ছোট–বড় যন্ত্রপাতি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে।
বিশেষায়িত এই হাসপাতালকে পাঁচটি কেন্দ্রে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে—জরুরি চিকিৎসা ও ট্রমা কেন্দ্র, কিডনি রোগ ও প্রতিস্থাপন কেন্দ্র, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্র, কার্ডিওভাস্কুলার রোগ ও স্ট্রোক কেন্দ্র এবং হেপাটোবিলিয়ারি, প্যানক্রিয়াটিক, হেপাটোলজি ও যকৃৎ প্রতিস্থাপন কেন্দ্র। প্রতিটি কেন্দ্রই যন্ত্রপাতিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর ১৪ সেপ্টেম্বর এই হাসপাতালের উদ্বোধন করেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা আর অদূরদর্শিতার কারণে হাসপাতালটি চালু করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ২২ ডিসেম্বর থেকে কয়েকটি বিভাগের বহির্বিভাগে কিছু রোগী দেখা হচ্ছে।
তিনি এ ব্যাপারে কিছু জানেন না। এ ধরনের চিঠি দেওয়ার ব্যাপারে অর্থ ও হিসাব শাখার কোনো মতামত নেওয়া হয়নি বা তাদের কিছু জানানো হয়নি।গৌর কুমার মিত্র, বিএসএমএমইউর পরিচালক (অর্থ ও হিসাব)
৩০ মে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, নিচতলায় কিছু যন্ত্রপাতির বাক্স খুলে বের করছেন কয়েকজন কর্মচারী, একজন কর্মকর্তা সেগুলোর ছবি তুলছেন। মা ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগে দেখা যায় প্লাস্টিকে মোড়ানো যন্ত্রের সারি। এসব যন্ত্র চালানোর জন্য যে লোকবল দরকার, তা এখনো নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
হাসপাতাল উদ্বোধন উপলক্ষে ছাপানো পুস্তিকায় বলা আছে, এই হাসপাতাল চালাতে এক হাজার জনবল নিয়োগ দেওয়া দরকার। যদিও ৩ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভার কার্যবিবরণিতে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের অনুমতিক্রমে এ পর্যন্ত নিয়োগ হয়েছে ১৮৪ জনের। অর্থাৎ ৮২ শতাংশ জনবল নিয়োগ এখনো বাকি। তবে সিন্ডিকেটের অনুমতির বাইরে আরও ৭০ জনের নিয়োগ হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানিয়েছে। গত মাসে বিএসএমএমইউতে নিয়োগে এ ধরনের অনিয়ম নিয়ে প্রথম আলোয় প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে।
৩ মে সভায় বলা হয়, বিশেষায়িত হাসপাতালের পরিচালনার জন্য একটি কমিটি গঠনসহ একজন সিইও নিয়োগ করতে হবে, একটি জনবল কাঠামো তৈরি করতে হবে। সর্বোপরি ১ জুলাই হাসপাতাল চালু করতে হবে।
হাসপাতাল চালু করার ব্যাপারে গতকাল মঙ্গলবার জানতে চাইলে বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক মো. শারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ মাসে হাসপাতাল চালু করার চেষ্টা করব।’ জনবলের ব্যাপারে তিনি বলেন, বিএসএমএমইউ থেকে লোক এনে আপাতত কাজ চালাবেন। প্রয়োজনে যন্ত্রপাতি বিএসএমএমইউ থেকেও আনবেন।
এদিকে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে চিঠি দিয়ে বলছে, তাদের উপার্জিত অর্থ প্রতিমাসে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে দিতে হবে, যাতে নতুন এই হাসপাতাল চালানো যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার স্বপন কুমার তফাদারের সই করা কার্ডিওলজি বিভাগের চেয়ারম্যানকে লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, এই বিভাগ থেকে মাসে ৩০ লাখ টাকা দিতে হবে।
উল্লিখিত বিভাগের একাধিক অধ্যাপক প্রথম আলোকে বলেন, এই বিভাগে অনেক যন্ত্রপাতি নেই। বিভাগের অর্থ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে দিতে হবে, এমন কোনো বিধি বা আইনও তৈরি হয়নি। এটা বেআইনি উদ্যোগ। সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল চলবে নিজের অর্থে বা সরকারের দেওয়া অর্থে।
এ ব্যাপারে বিএসএমএমইউর পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) গৌর কুমার মিত্র প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এ ব্যাপারে কিছু জানেন না। এ ধরনের চিঠি দেওয়ার ব্যাপারে অর্থ ও হিসাব শাখার কোনো মতামত নেওয়া হয়নি বা তাদের কিছু জানানো হয়নি।