হেপাটাইটিস পজিটিভ থাকা মানেই একজন ব্যক্তি অসুস্থ বা কাজে অক্ষম নন। নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ছাড়া হেপাটাইটিস ছড়ায়ও না। স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় হেপাটাইটিস পজিটিভ পেলে অনেক ক্ষেত্রে চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয় না, বিদেশে অভিবাসনে বা কাজ করতে যেতে দেওয়া হয় না। এসব ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস শনাক্তে পরীক্ষা বা স্ক্রিনিং করার বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।
গতকাল সোমবার হেপাটোলজি সোসাইটি ঢাকা বাংলাদেশ ও প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা বলেন, সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে হেপাটাইটিস প্রতিরোধে বেশি বেশি পরীক্ষা হওয়া প্রয়োজন। তবে হেপাটাইটিস পরীক্ষা শুধু ব্যক্তির সুবিধার জন্য করতে হবে। কখনো চাকরির শর্ত হিসেবে করা যাবে না এবং পরীক্ষার ফল গোপন রাখতে হবে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি হেপাটাইটিসমুক্ত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে শিশুর জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টিকা দেওয়ার সুপারিশ করেন তাঁরা।
হেপাটাইটিস নির্মূলে প্রথমেই দরকার হেপাটাইটিস রোগীদের নির্ণয় করা।অধ্যাপক মবিন খান, সভাপতি, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা
২৮ জুলাই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস উপলক্ষে গতকাল রাজধানীর কারওয়ানবাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘হেপাটাইটিস বি পজিটিভ—চাকরি, বিদেশ গমন বা চিকিৎসা গ্রহণে অযোগ্যতা নয়’ শিরোনামে গোলটেবিল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে বলা হয়, অনিরাপদ রক্ত সঞ্চালন, সুই, সিরিঞ্জ ব্যবহার ও অনিরাপদ দৈহিক সম্পর্কের মাধ্যমে হেপাটাইটিস ছড়ায়। নাক–কান ফুটো, সংক্রমিত ব্যক্তির টুথব্রাশ ও শেভিং যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে হেপাটাইটিস হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ২০১৭ সালে ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্স সিভিল সোসাইটির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন দেশের ৯৩ শতাংশ মানুষ মতামত দিয়েছেন, নিজ নিজ দেশে হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত ব্যক্তিরা কুসংস্কার ও বৈষম্যের শিকার। বাংলাদেশে ১ হাজার ৩৯ জনের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, চাকরি নিয়ে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন প্রায় ২৮ শতাংশ, সামাজিক বৈষম্যের শিকার প্রায় ১৫ শতাংশ, চিকিৎসা নিতে বাধার সম্মুখীন প্রায় ৯ শতাংশ, পরিবারে ৭ শতাংশ এবং শিক্ষাক্ষেত্রে ৪ শতাংশ মানুষ বৈষম্যের শিকার হয়েছে। বৈষম্যের ভয়ে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ৪৬ শতাংশ চাকরিক্ষেত্রে, ৭৬ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং ৭ শতাংশ পরিবারে তাঁদের রোগের কথা গোপন রেখেছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হেপাটোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক মবিন খান বলেন, হেপাটাইটিস নির্মূলে প্রথমেই দরকার হেপাটাইটিস রোগীদের নির্ণয় করা। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ নির্ণয়ে পরীক্ষা সহজলভ্য করতে হবে। শনাক্ত রোগীদের চিকিৎসার আওতায় আনা এবং হেপাটাইটিস যেন না হতে পারে, সে জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। টিকা হচ্ছে হেপাটাইটিস বি এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্যতম সফল অস্ত্র।
বিএসএমএমইউয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, হেপাটাইটিস ‘এ’ ‘বি’ ‘সি’ ‘ডি’ ও ‘ই’ আছে। আক্রান্ত ব্যক্তির পোশাক, থালাবাসন, হ্যান্ডশেক, কোলাকুলি ইত্যাদি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হেপাটাইটিস ছড়ায় না। তাই হেপাটাইটিস পজিটিভ ব্যক্তির সঙ্গে মেলামেশা করা যাবে না, তাঁদের চাকরিতে নেওয়া যাবে না—এ ধরনের মনোভাব দূর করতে হবে।
বিএসএমএমইউয়ের হেপাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও হেপাটোলজি সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. শাহিনুল আলম বলেন, হেপাটাইটিস পজিটিভ ব্যক্তিদের নিয়ে কুসংস্কার ও তাঁদের প্রতি সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্য রোগটি প্রতিরোধে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বৈষম্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল পর্যন্তও বিস্তৃত। অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এখন পরীক্ষা তুলে দিয়েছে। এটা নৈতিক বিষয়, চাকরি বা অভিবাসনের শর্ত হিসেবে এই পরীক্ষা থাকা উচিত নয়।
বারডেম জেনারেল হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি ও লিভার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও হেপাটোলজি সোসাইটির বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক মো. গোলাম আযম বলেন, বিশ্বে প্রতিবছর ১৪ লাখ মানুষ মারা যান হেপাটাইটিসে। বৈষম্য ও কুসংস্কার দূর করে হেপাটাইটিস পজিটিভ ব্যক্তিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞদের সংগঠন অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম বলেন, হেপাটাইটিস–সংক্রমিত অন্তঃসত্ত্বা মায়ের মাধ্যমে নবজাতকের মধ্যে ছড়ায় বলা হয়। তবে বলা উচিত, বাবা–মায়ের কাছ থেকে শিশু সংক্রমিত হয়। কারণ, স্বামী সংক্রমিত থাকলে দৈহিক সম্পর্ক থেকে স্ত্রীও সংক্রমিত হন।
প্রতিরোধব্যবস্থার ওপর জোর দিয়ে বিএসএমএমইউয়ের লিভার বিভাগের অধ্যাপক ও হেপাটোলজি সোসাইটির কোষাধ্যক্ষ মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, শিশু বয়সে হেপাটাইটিস সংক্রমিত হলে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগটি দীর্ঘমেয়াদে সংক্রমিত হওয়ার আশংকা থাকে।
বারডেম জেনারেল হাসপাতাল ও ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ও শিশু বিভাগের প্রধান আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, উন্নত দেশগুলোতে জন্মের পর পর শিশুকে হেপাটাইটিসের টিকা দেওয়া হয়। আমাদের দেশেও এটা শুরু করলে এবং মায়ের গর্ভাবস্থায় সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিলে শিশুদের আক্রান্ত হওয়া প্রতিরোধ করা যাবে। দেশে হেপাটাইটিস প্রতিরোধে জাতীয় কমিটি গঠন করা উচিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাহেরুল হক বলেন, জনস্বাস্থ্য সেবাপদ্ধতি নেওয়া ছাড়া হেপাটাইটিস প্রতিরোধে সফলতা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূলের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। উপজেলা পর্যায়ের একজন মানুষ যেন রাজধানীর শীর্ষ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসার সুবিধা নিতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
বিএসএমএমইউয়ের লিভার বিভাগের চিকিৎসক ও হেপাটোলজি সোসাইটির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মো. সাইফুল ইসলাম এলিন দেশে হেপাটাইটিস সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরে জানান, দেশে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত পুরুষের সংখ্যা ৫৭ লাখ, নারী ২৮ লাখ ও শিশু ৪ লাখ। চাকরিপ্রার্থী ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সের নাগরিকদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে অযৌক্তিকভাবে চাকরির ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করা হচ্ছে।
আলোচনায় আরও অংশ নেন ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার (মেডিসিন) তানভীর আহমাদ, কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের লিভার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও হেপাটোলজি সোসাইটির কার্যকরি সদস্য এস কে এম নাজমুল হাসান, হেপাটোলজি সোসাইটির ভারপ্রাপ্ত সহ সভাপতি মো. মোতাহার হোসেন। বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। বৈঠক সঞ্চালনা করে প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।