ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ছাত্রী নির্যাতন

তদন্তকালে ক্যাম্পাসে দুই নেত্রীর অবস্থান নয়: হাইকোর্ট

হাইকোর্ট
ফাইল ছবি

কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) ছাত্রী হলে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন, শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও ছাত্রলীগের যে দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে নির্যাতনে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের ক্যাম্পাসের বাইরে রাখাসহ কয়েক দফা নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন।

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরীর নেতৃত্বে তাঁর অনুসারীরা গত রোববার ইবির দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে প্রথম বর্ষের এক ছাত্রীকে নির্যাতন করেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

এ ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন যুক্ত করে ওই ছাত্রীকে আটকে রেখে নির্যাতন ও ভিডিও ধারণের অভিযোগে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা চেয়ে গতকাল বুধবার সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইবির সাবেক শিক্ষার্থী গাজী মো. মহসীন রিটটি করেন। আদালতে রিটের পক্ষে তিনি নিজেই শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়।

নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে হাইকোর্ট তিন দিনের মধ্যে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করতে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছেন। কমিটিতে প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা, জেলা জজ মনোনীত বিচার বিভাগীয় একজন কর্মকর্তা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী অধ্যাপককে রাখতে বলা হয়েছে।

কমিটি গঠনের পরবর্তী সাত দিনের মধ্যে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। ওই ঘটনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠিত কমিটিগুলোর প্রতিবেদনও ১০ দিনের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদনে বলা হয়, ইবিতে ভর্তির কয়েক দিনের মাথায় ছাত্রলীগ নেত্রীদের নিষ্ঠুরতার শিকার হন এক ছাত্রী। নেত্রীদের কথা না শোনার জেরে ১২ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে হলের গণরুমে (দোয়েল) তাঁকে ডেকে নেন ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী। সেখানে পাঁচ থেকে ছয়জনের একটি দল তাঁকে দিবাগত রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত নির্যাতন করেন। গালাগাল, মারধর, বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা হয়। সানজিদা চৌধুরী ও তাবাসসুম নামে অপর শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে।  

তদন্ত চলাকালে সানজিদা ও তাবাসসুম যাতে ইবি ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে না পারেন, সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, তবে তদন্তের প্রয়োজনে কমিটি তাঁদের ডাকতে পারবে।

অপর নির্দেশনায় আদালত নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। আদালত বলেছেন, ওই ঘটনা নিয়ে শিক্ষার্থীর ফৌজদারি মামলা করার স্বাধীনতা থাকবে। ধারণ করা ভিডিও যাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ না হয়, তা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে বিটিআরসিকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

এটি খুবই অ্যালার্মিং: হাইকোর্ট

গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন তুলে ধরে শুনানিতে আইনজীবী গাজী মো. মহসীন বলেন, একপর্যায়ে ওই ছাত্রীকে দিয়ে ময়লা গ্লাস চেটে পরিষ্কার করিয়ে নেওয়া হয়। এরপর পোশাক খুলতে বলা হয়। খুলতে না চাইলে তাঁরা আবার মারধর শুরু করেন, বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করেন। এরপর তাঁরা বলেন, যদি বাইরে কাউকে বলিস, তাহলে ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করে দেওয়া হবে।

আদালত বলেন, ওই ঘটনায় মামলা হয়নি? তখন গাজী মো. মহসীন বলেন, মামলা হয়নি। হল কর্তৃপক্ষ তদন্ত করছে। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করা হয়েছে। ৮ ফেব্রুয়ারি তাঁর ক্লাস শুরু হয়েছে।

আদালত বলেন, ভিডিও কি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দিয়েছে? তখন রিট আবেদনকারী আইনজীবী গাজী মো. মহসীন বলেন, না। এরপর রিটের প্রার্থনা অংশ তুলে ধরে তিনি বলেন, ঘটনায় জড়িত বলে দুজন নেত্রীর নাম এসেছে, তাঁদের ব্যক্তিগত হাজিরা চাওয়া হয়েছে। যাঁদের কাছে ভিডিও আছে, তাঁদের কাছ থেকে উদ্ধার করে মুছে দেওয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায় বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত চলছে। মেয়েটি তাঁর বাড়িতে আছেন। তদন্ত প্রতিবেদন এলে আরও বিস্তারিত জানা যাবে।  

আদালত বলেন, অভিযোগ কি দুজনের বিরুদ্ধে? তখন গাজী মো. মহসীন বলেন, এই দুজনসহ আরও কয়েকজন ছাত্রী। (ওই ছাত্রী) সবার নাম জানেন না, দুজনের নাম জানেন। তাই বাকিদের নাম বলতে পারেননি।

আদালত বলেন, যে দুজনের কথা বলা হচ্ছে, তাঁদের বাড়ি কোথায়? তখন গাজী মো. মহসীন বলেন, বাড়ির ঠিকানা জানা নেই। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানা দিয়ে দুজনকে বিবাদী করা হয়েছে। ছাত্রীর প্রাণনাশের হুমকি আছে। যদি তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা হয়, তাহলে তাঁর শিক্ষাজীবন চালিয়ে নেওয়া কঠিন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনো কারও বিরুদ্ধে মামলা করেনি। ওই দুজন এখনো বিশ্ববিদ্যালয় আছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বিষয়টি দলীয় নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

রিট আবেদনকারীর উদ্দেশে আদালত বলেন, যে তদন্ত হচ্ছে তা পর্যাপ্ত মনে করছেন কী? তখন রিট আবেদনকারী বলেন, আদালত বিচারিক তদন্তের নির্দেশনা দিতে পারেন।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য জানতে চাইলে তুষার কান্তি রায় আদালতকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আসুক। তখন আদালত বলেন, অনেক সময় হলের শিক্ষকেরা চাপে থাকেন। তাঁরা যথাযথভাবে কন্ডাক্ট করতে পারেন না।

এরপর আদালত রুলের পাশাপাশি নির্দেশসহ আদেশ দেন। এর আগে আদালত বলেন, এটি খুবই অ্যালার্মিং (উদ্বেগজনক। ওই মেয়ে ওখানে পড়তে পারবে কি না, তার নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে। তাকে টার্গেট করার কারণ কী? তখন গাজী মো. মহসীন বলেন, তাঁকে নেত্রী দেখা করতে বলেছেন, অসুস্থতার কারণে যেতে পারেননি। কেন এল না? হল নেত্রীদের রাজত্বের মতো। আগে এ রকম ছিল না।