মো. তৌহিদ হোসেনের সাক্ষাৎকার

শর্তহীন সংলাপের চিঠি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চাপের অংশ

ঢাকায় পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতা–কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় করা মামলায় দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এখন কারাবন্দী। এই অবস্থায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি দেশজুড়ে অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে। এ অবস্থায় সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিয়ে যখন অনিশ্চয়তা বাড়ছে, সে সময় নির্বাচন নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে বাংলাদেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলকে শর্তহীন সংলাপে বসতে আহ্বান জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। এই চিঠি কোনো ফলাফল বয়ে আনবে কি না, এর তাৎপর্য কী—এসব বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর কূটনৈতিক প্রতিবেদক রাহীদ এজাজ

মো. তৌহিদ হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব
ফাইল ছবি
প্রশ্ন

প্রথম আলো: সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে এল। যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ করেই শর্তহীন সংলাপে বসতে রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি দিল। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দুই দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের এমন উদ্যোগকে কীভাবে দেখছেন?

তৌহিদ হোসেন: যুক্তরাষ্ট্রের এই চিঠি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে তাদের চাপের অংশ। দেশটি বেশ কিছুদিন ধরেই বলছে, তারা বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। এ জন্য তারা চারপাশের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। সম্প্রতি দিল্লিতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের (২+২) বৈঠকে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গটি এসেছে। বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা ব্রিফিংয়ে যা বলেছেন তাতে স্পষ্ট যে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ভারত পছন্দ করছে না। আবার যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি, সেটাও স্পষ্ট।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: কিন্তু শেষ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া এ চিঠি কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

তৌহিদ হোসেন: আওয়ামী লীগ এ চিঠিকে কীভাবে নেয়, তার ওপরই বিষয়টির গুরুত্ব নির্ভর করছে। কারণ, সংলাপের দায়িত্ব তো ক্ষমতাসীন দলের ওপরই পড়ে। আবার শর্তহীন সংলাপ যখন যুক্তরাষ্ট্র বলছে, বিএনপি এতে কী প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে, সেটা জানা জরুরি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের স্বার্থে শর্তহীন সংলাপের কথা বলছে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে আওয়ামী লীগ বলছে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। আর বিএনপি বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। অন্যদিকে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের বেশির ভাগই জেলে। এমন পরিবেশে সংলাপ কি আদৌ সম্ভব?

তৌহিদ হোসেন: না, আমি সংলাপের ব্যাপারে খুব আশাবাদী নই। আবার রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। প্রথম বিষয়টি হচ্ছে, শর্তহীন সংলাপে বসা। শর্ত ছাড়ার প্রশ্ন এলে সরকারকে ‘সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন’ আর বিএনপিকে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন’ এমন অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। দুই পক্ষকেই মাঝামাঝি জায়গায় আসতে হবে।

দ্বিতীয়ত, সরকার চাইলেই এক দিনের মধ্যেই বিএনপি নেতাদের মুক্তি দিয়ে সংলাপের সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার সংলাপ চায় কি না?

প্রশ্ন

প্রথম আলো: তার মানে, সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর সংলাপ নির্ভর করছে?

তৌহিদ হোসেন: প্রধানত সরকারের ওপর তা নির্ভর করছে। আবার শর্তহীন সংলাপে বিএনপি কী প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এমন এক অনিশ্চিত পরিবেশে আদৌ শর্তহীন সংলাপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে কোনো সমাধান আসবে?

তৌহিদ হোসেন: আপাতদৃষ্টে আমি যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে কোনো ফল দেবে বলে মনে করি না। কারণ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা যেভাবে শক্তিশালী অবস্থান প্রতিদিন তুলে ধরছেন, তাতে সংলাপ নিয়ে আমি আশাবাদী নই।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: সংলাপের আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি দিয়েছে, তাতে ভিসা নীতির কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়টির তাৎপর্য কী?

তৌহিদ হোসেন: যুক্তরাষ্ট্র অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিতের স্বার্থে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। শর্তহীন সংলাপের চিঠিতে এ প্রসঙ্গটি জুড়ে দিয়ে দেশটি এই বার্তা দিতে চাইছে যে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে ব্যত্যয় ঘটলে ভিসা নীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজন হলে নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপও নিতে পারে। অর্থাৎ অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা শুধু কথার কথা নয়।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত আহ্বান বা চাপ কি কূটনৈতিক রীতিনীতির লঙ্ঘন নয়?

তৌহিদ হোসেন: দেখুন, শক্তিশালী কোনো দেশ যদি বিশেষ কোনো লক্ষ্য অর্জন করতে চায়, তারা তখন নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে সব সময় রীতিনীতি বা শিষ্টাচার অনুসরণ করে তা কিন্তু নয়। বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের যে চেষ্টা, সেটাকে শক্তিমান দেশের কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া যায়।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
তৌহিদ হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।