বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আগ্রহ ভর্তিতে। চিকিৎসক তৈরিতে বিনিয়োগ কম।
২৫ মে সকাল নয়টায় রাজশাহীর শাহ্ মখদুম মেডিকেল কলেজে গিয়ে এর অধ্যক্ষকে পাওয়া যায়নি। কলেজে বেলা একটা পর্যন্ত কোনো শিক্ষক আসেননি, কোনো শিক্ষার্থীও চোখে পড়েনি। পরিবেশ দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এটি একটি মেডিকেল কলেজ। আছে শুধু সাইনবোর্ড।
মেডিকেল কলেজটি রাজশাহী মহানগরের খড়খড়ি এলাকায়। কলেজের অভ্যর্থনার দায়িত্বে থাকা কর্মচারীরা এই প্রতিবেদককে বলেন, দায়িত্বশীল কারও সঙ্গে কথা বলতে হলে সকাল ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
৯ বছর আগে ২০১৪ সালে বেসরকারি এই মেডিকেল কলেজের যাত্রা শুরু হয়েছিল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কলেজটির কার্যক্রম একাধিকবার স্থগিত করেছে। কর্তৃপক্ষ আদালতের অনুমতি নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি অব্যাহত রাখে। তবে এ পর্যন্ত এই কলেজ থেকে কোনো শিক্ষার্থী এমবিবিএস চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। বর্তমানে কলেজে শিক্ষার্থী আছেন ৪০ জন।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোকে নিয়মনীতির মধ্যে আনা হচ্ছে। যারা কথা শুনছে না, এমন ছয়টিকে বন্ধ করেছি। কলেজ পরিচালনার নীতিমালা তৈরি হয়েছে।অধ্যাপক মো. টিটো মিয়া, মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর
দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ৭৭টি। অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে শাহ্ মখদুমসহ ছয়টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমতি দেয়নি স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই তালিকায় অন্য মেডিকেল কলেজগুলো হলো ঢাকার কেয়ার, নর্দান, আইচি ও নাইটিঙ্গেল এবং রংপুরের নর্দান মেডিকেল কলেজ। এই প্রতিবেদক রাজশাহীর শাহ্ মখদুম ছাড়াও তালিকার বাইরে থাকা খুলনা শহরে দুটি এবং ঢাকার তিনটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ঘুরে দেখেছেন। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক। হাতে-কলমে শিক্ষারও ঘাটতি রয়েছে।
খবর পেয়ে সকাল সাড়ে ১০টায় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান মেডিকেল কলেজে আসেন। তিনি এই প্রতিবেদককে মেডিকেল কলেজ ঘুরিয়ে দেখান। তিনতলা ভবনের প্রায় সব কক্ষ দেখার সুযোগ হয়। প্রতিটি কক্ষের আসবাব, যন্ত্রপাতিতে ধুলার ভারী আস্তরণ। একটি কক্ষে প্লাস্টিকে ঢাকা বেশ কয়েকটি অণুবীক্ষণযন্ত্র চোখে পড়ল। এসব কক্ষ, আসবাব, যন্ত্রপাতি কত দিন ব্যবহৃত হয়নি, তা বলা মুশকিল।
মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমার কলেজের জায়গার অভাব নেই, হাসপাতালের জন্য যে পরিমাণ জমি দরকার, তা–ও আমার আছে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ আইন ২০২২ অনুযায়ী, কলেজের জন্য দুই একর জমি দরকার। প্রতি ৫০ জন শিক্ষার্থীর জন্য দরকার কলেজে এক লাখ এবং হাসপাতালে এক লাখ বর্গফুট আয়তনের মেঝে। কিন্তু শাহ্ মখদুম মেডিকেল কলেজের তা নেই। শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখার জন্য কলেজের হাসপাতালে কমপক্ষে ২৫০টি শয্যা ও ১৭৫টি শয্যায় নিয়মিত রোগী থাকা দরকার। হাসপাতালে শয্যা আছে ১১২টি, তাতে নিয়মিত ৩০ জন রোগীও থাকে না।
আমার কলেজের জায়গার অভাব নেই, হাসপাতালের জন্য যে পরিমাণ জমি দরকার, তা–ও আমার আছে।প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান
কলেজ চালু, শিক্ষাদান ও পরীক্ষা এবং নিবন্ধনের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) ও সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনের দরকার হয়। এই চারটি কর্তৃপক্ষের একটিরও অনুমোদন নেই শাহ্ মখদুম মেডিকেল কলেজের। তারপরও এই কলেজে ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল।
মো. মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কিন্ডারগার্টেন চালানোর অভিজ্ঞতা তাঁর আছে। একসময় ঠিকাদারি করতেন, জমি কেনাবেচার ব্যবসাও আছে। শুরুর দিকে কলেজের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ছিলেন একজন সাংসদ। তাঁকে বাদ দিয়ে এখন সভাপতি করা হয়েছে জিল্লার রহমানকে।
জিল্লার রহমান একসময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ছিলেন। মো. মনিরুজ্জামানের ভাষ্য অনুযায়ী, জিল্লার রহমান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা করছেন।’ ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে মেডিকেল কলেজটি পরিদর্শন করতে অনুরোধ করেছে। পাশাপাশি হাইকোর্টে দৌড়াদৌড়ি করছেন মো. মনিরুজ্জামান। তিনি আদালতে গিয়ে বর্তমান শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তির চেষ্টা চালাবেন বলে জানিয়েছেন।
প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জিল্লার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অফিশিয়ালি আমার নাম কলেজের সঙ্গে আছে। তবে আমি কোনো কাজের সঙ্গে নেই।’
মেডিকেলে লিখিত, মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষার গুরুত্ব সমান। তবে চিকিৎসা শিক্ষায় হাতে-কলমে শেখার গুরুত্ব অনেক বেশি। এর জন্য শিক্ষার্থীদের তৃতীয় বর্ষ থেকেই রোগীর মুখোমুখি হতে হয়, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে রোগীর পাশে থেকে শিখতে হয়। কিন্তু বেশ কিছু বেসরকারি মেডিকেলে হাতে–কলমে শেখার জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক রোগী হাসপাতালে থাকে না।
৮ জুন মুঠোফোনে কথা হয় কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ফাতিমা সিদ্দিকার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি কলেজে অনিয়মিত।’ তিনি জানেন না যে কলেজে কত শিক্ষার্থী আছেন, কত শিক্ষক আছেন। আপনি কি কলেজ থেকে নিয়মিত বেতন নেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি পারিবারিক কাজে ঢাকায় আছি। সম্ভব হলে সামনাসামনি কথা হবে।’
সর্বশেষ ২০২০ সালের স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, চিকিৎসা শিক্ষা প্রদানের জন্য কলেজটিতে ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা নেই।
অবকাঠামোগত সৌন্দর্য বৃদ্ধির একটা চেষ্টা চলছে, যা অল্প সময়ে সম্ভব। কিন্তু শিক্ষক তৈরির কার্যকর উদ্যোগ নেই, অল্প সময়ে তা সম্ভবও নয়। তাই ভালো চিকিৎসক বা মানসম্পন্ন মানবসম্পদ আমরা আশা করতে পারি না।জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব
শর্ত না মেনে চলছে অনেক মেডিকেল কলেজ। যেমন রাজধানীর মিরপুর-১৪ এলাকায় মার্কস মেডিকেল কলেজ। রাজধানীর বা দেশের বড় বড় শহরের বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকের আয়তন এই মেডিকেল কলেজের চেয়ে বড়। এই কলেজের সবকিছু আকারে ছোট। শ্রেণিকক্ষ ছোট, লাইব্রেরি ছোট, ছোট ছোট বারান্দা। হাসপাতাল অংশের নিচতলায় ১০৩, ১০৪, ১০৫ ও ১০৬ নম্বর কক্ষে যথাক্রমে সার্জারি, শিশুরোগ, মেডিসিন এবং স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিভাগের বহির্বিভাগ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতিটি কক্ষের আয়তন খুবই ছোট, কোনোরকমে একটি শয্যা ও একটি চেয়ার পাতার জায়গা আছে।
২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজ ও হাসপাতালের জন্য যে পরিমাণ জায়গা দরকার, তাদের তা নেই। বছরে ৭০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমোদন তাদের আছে। কিন্তু কোনো কিছুই পর্যাপ্ত নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে এমন অভিযোগ আছে যে হাসপাতাল পরিদর্শনের সময় হাসপাতালে ভর্তি ব্যক্তিদের প্রকৃত রোগী বলে মনে হয়নি অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের।
তবে কলেজটির অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. এনামুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, অল্প কিছুদিন আগে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে এই কলেজের দায়িত্ব নিয়েছেন। তাই তিনি কোনো বিষয়ে মন্তব্য করতে চান না।
মেডিকেলে লিখিত, মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষার গুরুত্ব সমান। তবে চিকিৎসা শিক্ষায় হাতে-কলমে শেখার গুরুত্ব অনেক বেশি। এর জন্য শিক্ষার্থীদের তৃতীয় বর্ষ থেকেই রোগীর মুখোমুখি হতে হয়, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে রোগীর পাশে থেকে শিখতে হয়। কিন্তু বেশ কিছু বেসরকারি মেডিকেলে হাতে–কলমে শেখার জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক রোগী হাসপাতালে থাকে না। ৪০ শতাংশ বেসরকারি মেডিকেলে এই সমস্যা আছে বলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন।
ব্যবহারিক শিক্ষা কমতি থাকার ব্যাপারে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইসমাইল খান প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ বছরের শিক্ষা কার্যক্রমের শেষ সাড়ে তিন বছর মূলত ব্যবহারিক শিক্ষা। হাসপাতালে রোগী না থাকলে এই শিক্ষা পরিপূর্ণ হয় না। দক্ষ ও আত্মবিশ্বাসী চিকিৎসক হতে গেলে রোগীর কাছে থেকেই শিখতে হয়। হাসপাতালে রোগী না থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রে গুণগত মেডিকেল শিক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে না।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে বিনিয়োগ অনেক। কলেজগুলোর দিন দিন উন্নতি হচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে সব সীমাবদ্ধতা যেন কাটিয়ে উঠতে পারে, সে চেষ্টা আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকেও আছেবেসরকারি মেডিকেল কলেজ মালিকদের সংগঠন প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এম এ মোবিন খান
সাধারণ ক্লাসের পাশাপাশি মেডিকেলে প্রায় প্রতিদিন পরীক্ষা থাকে। শিক্ষণ ও ব্যবহারিক শিক্ষা হতে হয় নিবিড়ভাবে। এর জন্য বেশিসংখ্যক শিক্ষকের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের অনুপাত নির্ধারণ করে দিয়েছে। প্রতিটি বিষয়ে ১০ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১ জন শিক্ষক থাকতে হবে। অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক এবং প্রভাষকের সংখ্যা কী হবে, তা–ও বলা আছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের দেওয়া পরিসংখ্যান বলছে, অনুমোদিত ৭৭টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে ৬টিতে অ্যানাটমির কোনো অধ্যাপক নেই, ১৬টি কলেজে ফিজিওলজির অধ্যাপক নেই, ১৭টি কলেজে বায়োকেমিস্ট্রির অধ্যাপক নেই, ১৮টি কলেজে ফরেনসিক মেডিসিনের অধ্যাপক নেই। এ রকম আরও অনেক বিষয়ে অধ্যাপক নেই। একইভাবে সহযোগী অধ্যাপক নেই। কোনো কোনো কলেজে একই বিষয়ে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক এমনকি সহকারী অধ্যাপকও নেই। সেসব কলেজে কাজ চালানো হচ্ছে প্রভাষক দিয়ে।
সমস্যাটি অন্যভাবে মেটানোর চেষ্টা চলছে। সরকারি মেডিকেলের শিক্ষকদের বয়সসীমা ৬০ বছর, বেসরকারি মেডিকেলে ৬৫ বছর। বয়স বেশি হওয়ার কারণে সরকারি মেডিকেলে যাঁদের যোগ্য বলে বিবেচনা করা হচ্ছে না, তাঁরা যোগ্য হচ্ছেন বেসরকারি মেডিকেলে। তাই দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও অধ্যাপক পদে আছেন সরকারি মেডিকেল কলেজ বা সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে অবসরে যাওয়া চিকিৎসক–কর্মকর্তা।
ঢাকার বাইরে একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রথম আলোকে বলেছেন, শিক্ষকের সংকট খুবই তীব্র। তাই তাঁর কলেজে এমন দুজন অধ্যাপককে রাখতে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন, যাঁদের বয়স ৬৫ বছরের বেশি।
খুলনা শহরে গত কয়েক মাসে অন্তত ১০ জন অধ্যাপক সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজে যুক্ত হয়েছেন বলে কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রথম আলোকে জানিয়েছে। ৪ জুন দেখা যায়, কলেজটির প্রধান কার্যালয় খুলনার রয়্যাল মোড়ের একটি আবাসিক ভবনে।
শিক্ষকস্বল্পতা নিয়ে মেডিকেল শিক্ষা কীভাবে চলছে—এমন প্রশ্নের উত্তরে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, ‘অবকাঠামোগত সৌন্দর্য বৃদ্ধির একটা চেষ্টা চলছে, যা অল্প সময়ে সম্ভব। কিন্তু শিক্ষক তৈরির কার্যকর উদ্যোগ নেই, অল্প সময়ে তা সম্ভবও নয়। তাই ভালো চিকিৎসক বা মানসম্পন্ন মানবসম্পদ আমরা আশা করতে পারি না।’
শিক্ষক বা হাসপাতালে রোগী থাকুক বা না থাকুক, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর আগ্রহ শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যাপারে। ভর্তি ফি থেকে কলেজগুলো প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ আয় করে। অনেকে ভর্তির টাকা থেকে শিক্ষকদের বেতন দেয়, অবকাঠামো গড়ে তোলে।
২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে আসন বরাদ্দ আছে ৬ হাজার ৭৭২টি। ভর্তি ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ভর্তির সময় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে ২০ লাখ টাকা। অর্থাৎ সব আসনে শিক্ষার্থী ভর্তি হলে কলেজগুলোর আয় ১ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা।
তবে ভর্তি থেকে প্রকৃত আয়ের পরিমাণ আরও বেশি। কারণ, অনেক কলেজে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করার অনুমোদন আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, প্রতিবছর আড়াই হাজারের মতো বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হন। তাঁদের ফি দেশি শিক্ষার্থীদের চেয়ে বেশি।
বেসরকারি খাতে সবচেয়ে পুরোনো বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ। রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। এই কলেজ বছরে ১২০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করে আসছে। এ বছর এই কলেজ ভর্তি থেকে আয় করবে ২৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রতি মাসে একজন শিক্ষার্থীর বেতন ১০ হাজার টাকা। এই কলেজ কমপক্ষে ৫০ জন বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পারবে। এতে তাদের আয় আরও বেড়ে যাবে। অন্যদিকে কলেজের হাসপাতালটিও লাভজনক।
কলেজ প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান শর্ত কলেজের নামে জমি থাকা। বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের নামে কোনো জমি নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বারবার সতর্ক করেছে। ৩৭ বছর শর্ত না মেনে কলেজটি চলছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ মালিকদের সংগঠন প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এম এ মোবিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে বিনিয়োগ অনেক। কলেজগুলোর দিন দিন উন্নতি হচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে সব সীমাবদ্ধতা যেন কাটিয়ে উঠতে পারে, সে চেষ্টা আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকেও আছে।’
যুক্তরাজ্য সরকারের আর্থিক সহায়তায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ২০১৬ সালে নতুন প্রতিষ্ঠিত মেডিকেল কলেজের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি গবেষণা হয়েছিল। তাতে সরকারি মেডিকেলের পাশাপাশি বেসরকারি মেডিকেলের নানা ত্রুটি ধরা পড়ে।
ওই গবেষণায় দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একই নিয়মে চলে না। কোনো কোনোটি লিমিটেড কোম্পানি, কোনোটি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে চলে, কোনোটি চালায় ট্রাস্ট। কোনো কোনো কলেজের ভবন কলেজ চালানোর উপযুক্ত নয়। অনেকের মেডিকেল জার্নাল নেই। অনেকের প্রয়োজনীয় জায়গা নেই। অনেকের পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই।
গবেষণার শেষের দিকে কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল: মেডিকেল কলেজ পরিদর্শনের সঙ্গে যুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে, শিক্ষকস্বল্পতা দূর করার উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিষ্ঠার সব শর্ত পূরণ না হলে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে আর কোনো মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। এর কোনো কিছুই সরকার করেনি।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. টিটো মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোকে নিয়মনীতির মধ্যে আনা হচ্ছে। যারা কথা শুনছে না, এমন ছয়টিকে বন্ধ করেছি। কলেজ পরিচালনার নীতিমালা তৈরি হয়েছে। আশা করি পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’