নামমাত্র তদন্ত, লোকদেখানো ব্যবস্থা

ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে এক বছরে ১৯টি কমিটি। ১২টি প্রতিবেদন জমাই দেয়নি।

শাটল ট্রেনের ছাদে চড়ে যাওয়ার সময় গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে হেলে পড়া গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১৬ শিক্ষার্থী আহত হয়েছিলেন। এ ঘটনাকে ‘পুঁজি’ করে সেদিন রাতে ভাঙচুর করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৫টি যানবাহন। এমনকি উপাচার্যের বাসভবন, শিক্ষক ক্লাব, পুলিশ বক্সে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগও করা হয়। ভাঙচুরের এ ঘটনা তদন্তে তড়িঘড়ি করে কমিটি গঠন করে কর্তৃপক্ষ। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে সময় বেঁধে না দিলেও দ্রুততম সময়ের কথা বলা হয়। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন এক মাসেও জমা পড়েনি।

কমিটির প্রধান ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ বশির আহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত চলছে। এখনো তাঁরা প্রতিবেদন জমা দিতে পারেননি। কবে দিতে পারবেন, সে প্রশ্নের উত্তরও দেননি তিনি।

শুধু এ ঘটনা নয়, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অন্তত ১৯টি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কর্তৃপক্ষ। ভাঙচুর, সংঘর্ষ, ছাত্রীর নিরাপত্তা, সাংবাদিককে মারধর, প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে দুর্ব্যবহারসহ বিভিন্ন ঘটনায় এসব কমিটি গঠন করা হয়। ১২টি কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়নি। ৬টি কমিটি প্রতিবেদনে যে সুপারিশ দিয়েছে, সে অনুযায়ী ‘লোকদেখানো’ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

অন্যদিকে গত ২৪ সেপ্টেম্বর ক্যাম্পাসের দ্বিতীয় কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের সামনে প্রতিবেদন প্রকাশের জেরে প্রথম আলোর প্রতিনিধি মোশাররফ শাহকে মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি ৪ অক্টোবর প্রতিবেদন জমা দেয়। কিন্তু প্রতিবেদন সন্তোষজনক হয়নি বলে জানিয়েছেন উপাচার্য শিরীণ আখতার। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, প্রতিবেদন জমা দিলেও এটি সন্তোষজনক মনে হয়নি। মারধরে কারা জড়িত, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে, তা স্পষ্ট হয়নি। এ কারণে কমিটির সঙ্গে তিনি আবার বসবেন।

ছাত্রলীগের ‘ভয়েই’ প্রতিবেদন জমা দিতে পারেন না বলে মন্তব্য করেছেন বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই শিক্ষকেরা বলেন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সদিচ্ছা বর্তমান প্রশাসনের নেই। এ কারণে বেশির ভাগ কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয় না।

তবে প্রতিবেদন জমা না দেওয়ার বিষয়ে প্রশাসনিক ও একাডেমিক কাজের ‘অজুহাত’ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কে এম নূর আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষকেরা প্রশাসনিক ও একাডেমিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। এ কারণে প্রতিবেদন জমা দিতে পারেন না।

‘অজুহাতে’ আটকে কমিটি

গত বছরের ১৭ জুলাই রাত সাড়ে নয়টার দিকে ক্যাম্পাসে পাঁচ তরুণের হাতে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন ও মারধরের শিকার হন। এ ঘটনায় মামলা হয়, গ্রেপ্তার হন পাঁচজন। পরে তাঁরা জামিনে বের হয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে আসেন। আর ওই ছাত্রী ১২ জুন প্রক্টরের কাছে নিরাপত্তা চেয়ে চিঠি দেন। কারণ, ক্যাম্পাসে চলাফেরার সময় তাঁর উদ্দেশে মন্তব্য ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে। নিরাপত্তা নিয়ে তিনি শঙ্কিত।

এ ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয় মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবুল মনছুরকে। তিন মাস পার হলেও প্রতিবেদন জমা দিতে না পারার বিষয়টি স্বীকার করে এই শিক্ষক বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বক্তব্য জোগাড় করা সম্ভব হয়নি।

অন্যদিকে আলাওল হলের প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিতে ২৪ আগস্ট হলে ছাত্রলীগের তালা, পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগের দাবিতে ১ জুন প্রক্টর ও রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে ছাত্রলীগের তালা, একই দিন ছাত্রলীগের উপপক্ষ সিএফসি ও সিক্সটি নাইনের মধ্যে সংঘর্ষ, ৫ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গুদাম থেকে দরপত্র ছাড়াই মালামাল নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ও কর্মকর্তাদের হেনস্তা করা, ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ, ৭ ফেব্রুয়ারি জ্যেষ্ঠ নেতার সামনে ধূমপান করার জেরে তিন উপপক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় পৃথক কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু কোনো কমিটিই প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি।

কাগজে-কলমে বহিষ্কার

গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত কক্ষ ভাঙচুর, সংঘর্ষসহ পাঁচটি ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এসব কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির ৪ জন পদধারী নেতা ও ১৩ কর্মীকে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বেশির ভাগ নেতা-কর্মী হলে থেকেছেন, পরীক্ষায়ও অংশ নিয়েছেন। ১১ জনের বহিষ্কারাদেশ পরে তুলেও নেওয়া হয়।

কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি করে কোনো রকমে দায় সেরেছে বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষক দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে বর্তমান প্রশাসন। প্রতিবেদন আদায় করতে কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি ব্যর্থ। বিভিন্ন অনিয়মে জর্জরিত হয়ে বর্তমান প্রশাসনের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে পৌঁছে গেছে।