আইসিটি বিভাগ

জনতার সরকার, বৈঠক ও আলাপনে ব্যয় কোটি টাকা, ব্যবহার সামান্য

কিছুদিন পরপর ওয়েবসাইট ও অ্যাপ তৈরির প্রকল্প দেখা যায়। এরপর উদ্বোধন হয়, তারপর আর খোঁজ থাকে না।

জনগণের সঙ্গে সরকারের সরাসরি যোগাযোগ ও সম্পৃক্ততা বাড়াতে ‘জনতার সরকার’ নামে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেছিল তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ। ব্যয় হয়েছিল ৩ কোটি টাকা।

ওয়েবসাইটটি গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ঘটা করে উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ বলেন, এটি দেশের সাধারণ জনগণ ও সরকারের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করবে।

এক বছরের বেশি সময় পর দেখা যাচ্ছে, জনতার সরকার ওয়েবসাইটটি তেমন কোনো কাজে লাগছে না। সাধারণ মানুষের মধ্যে এটির ব্যবহার নেই বললেই চলে।

সাইটটি তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) ‘বাংলাদেশ সরকারের জন্য নিরাপদ ই-মেইল ও ডিজিটাল লিটারেসি সেন্টার স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে। এটি কী কাজে লাগছে, তা জানতে প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল আলম খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে প্রায় এক মাস ধরে। মুঠোফোনে কল করে, খুদে বার্তা পাঠিয়ে এবং তাঁর কার্যালয়ে গিয়েও এ বিষয়ে বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

শুধু জনতার সরকার নয়, অনলাইনে বৈঠক করার মাধ্যম ‘বৈঠক’ ও ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম ‘আলাপন’ও জনপ্রিয়তা পায়নি। যদিও বলা হয়েছিল, বিদেশি মাধ্যম জুম ও গুগল মিটের বিকল্প হবে বৈঠক এবং হোয়াটসঅ্যাপের মতো মাধ্যমগুলোর বিকল্প হবে আলাপন।

অ্যাপ ও সাইটগুলো প্রয়োজনেই তৈরি করা হয়। যাদের জন্য করা হয়, প্রকল্প শেষে তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এরপর সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। কর্তৃপক্ষই বলতে পারবে পরবর্তী সময়ে সেগুলো কী অবস্থায় থাকে।
জুনাইদ আহ্‌মেদ, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী

এর আগে আইসিটি বিভাগ এর আগে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রায় ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬০০ অ্যাপ তৈরি করেছিল। সেগুলোও তেমন কোনো কাজে আসেনি।

দেশে সরকারের তৈরি বিভিন্ন ভবন ও অন্যান্য অবকাঠামো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। এখন দেখা যাচ্ছে, সরকারের তৈরি ‘ডিজিটাল অবকাঠামো’র অনেকগুলো কাজে আসছে না। ফলে অর্থের অপব্যয় হচ্ছে। আইসিটি বিভাগ অবশ্য এসব বিবেচনায় না নিয়ে ফেসবুকের বিকল্প হিসেবে ‘যোগাযোগ’ ও নেটফ্লিক্সের মতো ‘ড্রিমস্ট্রিম’ নামে অনলাইনে ভিডিও সম্প্রচার (স্ট্রিমিং) মাধ্যম তৈরির কথা ভাবছে। এদিকে ‘তর্জনী’ নামে জাতীয় মোবাইল ব্রাউজার অ্যাপ গত মার্চে উদ্বোধন করা হয়েছে।

আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ প্রথম আলোকে বলেন, অ্যাপ ও সাইটগুলো প্রয়োজনেই তৈরি করা হয়। যাদের জন্য করা হয়, প্রকল্প শেষে তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এরপর সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। কর্তৃপক্ষই বলতে পারবে পরবর্তী সময়ে সেগুলো কী অবস্থায় থাকে।

জনতার সরকার কী কাজে লাগে

জনতার সরকার নামের ওয়েবসাইটটি তৈরির উদ্দেশ্য ছিল সরকারের উন্নয়নকাজের বিষয়ে নাগরিকদের মতামত ও চিন্তাভাবনা জানা, যাতে সরকার জনগণের বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি জেনে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

ওয়েবসাইটটির তথ্য অনুযায়ী, চালুর পর থেকে গতকাল শুক্রবার রাত পর্যন্ত এর নিবন্ধিত ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২০৮। জরিপের জন্য সর্বশেষ প্রশ্ন তোলা হয়েছে গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর। সাইটের একটি অংশে বলা হয়েছে, জরিপে অংশ নিয়েছেন মোট ১০ জন।

ওয়েবসাইটটিতে মূলত সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নকাজ ও পদক্ষেপের ভিডিও এবং সংবাদ তুলে ধরা হয়েছে। সেসব সংবাদের তেমন কোনো পাঠক নেই। যেমন গতকাল সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ‘বাণিজ্য সম্প্রসারণে যৌথভাবে কাজ করবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও এফবিসিসিআই’ শিরোনামের খবরটির কোনো পাঠক ছিল না। এই প্রতিবেদক খবরটির লিংকে ক্লিক করার পর একজন পাঠক দেখায়।

শুধু জনতার সরকার নয়, অনলাইনে বৈঠক করার মাধ্যম ‘বৈঠক’ ও ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম ‘আলাপন’ও জনপ্রিয়তা পায়নি। যদিও বলা হয়েছিল, বিদেশি মাধ্যম জুম ও গুগল মিটের বিকল্প হবে বৈঠক এবং হোয়াটসঅ্যাপের মতো মাধ্যমগুলোর বিকল্প হবে আলাপন।

জনতার সরকার নামের সাইটটির স্বীকৃত ফেসবুক পেজ অনুসরণ করেন মাত্র ৮৮৩ জন। এক্সে (সাবেক টুইটার) এর অনুসারী মাত্র ১০ জন।

জনতার সরকার ওয়েবসাইটের তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে আইসিটি বিভাগ সূত্র। ওয়েবসাইটটি করা হয়েছে ভারত ও মালয়েশিয়ার সরকারি দুটি সাইটের আদলে। ওই দুই দেশের সাইট দুটি ঘেঁটে দেখা যায়, সেখানে নানা ধরনের কার্যক্রম রয়েছে। সেগুলো অনেকটা সক্রিয়।

বৈঠকে বৈঠক কম

করোনাকালে দেশে অনলাইন বৈঠক জনপ্রিয় হয়। ব্যবহার বাড়ে জুম ও গুগল মিটের মতো অনলাইন বৈঠকের মাধ্যমগুলোর। সরকারি বিভিন্ন সভাও তখন অনলাইনে হতো।

আইসিটি বিভাগ ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল ‘বৈঠক’ চালু করে। এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল, জুমের মতো বাণিজ্যিক প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সরকারি সভা করার ক্ষেত্রে তথ্য ফাঁস বা নিরাপত্তাঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। বৈঠক হবে নিরাপদ মাধ্যম।

বৈঠক মাধ্যমটি তৈরি হয়েছিল বিসিসির অধীনে। বিসিসি থেকে জানা যায়, বৈঠকে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮৫০টির বেশি সভা হয়েছে। গ্রাহক হয়েছেন ২০০ জন। এটি ৫ হাজারের বেশি বার ডাউনলোড হয়েছে।

বিসিসি সূত্র বলছে, বৈঠকের পেছনে এখন পর্যন্ত কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। এটি ব্যবহারে গ্রাহকের দৈনিক ব্যয় ৫০ টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বৈঠক ব্যবহারে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহ নেই। পাশাপাশি করোনা মহামারি না থাকায় অনলাইন মাধ্যমগুলোর ব্যবহার কমেছে। তারপরও সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অনলাইনে সভা করতে গেলে বিদেশি মাধ্যমগুলোই ব্যবহার করে।

যেমন ৭ নভেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি জুমে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোভুক্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করে। আইসিটি বিভাগ গত ৬ জুলাই চলতি অর্থবছরের ক্রয় পরিকল্পনা, কর্মপরিকল্পনা এবং ব্যয়সংক্রান্ত একটি অনলাইন সভা করে জুমে।

চেষ্টা করেও বৈঠকের ব্যবহার নিয়ে বিসিসির কারও আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

আলাপন আড়ালে

সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিজস্ব যোগাযোগ ও ফাইল আদান-প্রদানের জন্য ‘আলাপন’ নামের একটি মাধ্যম তৈরি করেছিল বিসিসি। বলা হয়েছিল, এর মাধ্যমে বার্তা আদান-প্রদানে গোপনীয়তা রক্ষা হবে।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আলাপন উদ্বোধন করা হয়। এটি তৈরি করা হয়েছিল একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে, নাম রিভ সিস্টেমস। তারা জানিয়েছে, ২০১৮ সাল পর্যন্ত আলাপন দেখভালের দায়িত্ব ছিল তাদের।

আলাপন তৈরিতে কত টাকা ব্যয় হয়েছে, তা জানা যায়নি। বিসিসি সূত্রে জানায়, অ্যাপটিতে নিরাপত্তা ত্রুটি থাকায় তা পরে ব্যবহার করা হয়নি।

নতুন এসেছে ‘তর্জনী’

আইসিটি বিভাগ গত মার্চে জাতীয় মোবাইল ব্রাউজার অ্যাপ তর্জনী চালু করে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ বলেছিলেন, বিদেশি সেবার ওপর নির্ভর না করে নিজেদের স্বাবলম্বী হতে হবে। সে জন্যই ব্রাউজারটি চালু করা হয়েছে। তখন তিনি আরও জানান, ভবিষ্যতে নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেমও চালু করা হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কিছুদিন পরপর ওয়েবসাইট ও অ্যাপ তৈরির প্রকল্প দেখা যায়। এরপর উদ্বোধন হয়, তারপর আর খোঁজ থাকে না। সরকারের এসব উদ্যোগ এখন উদ্বোধননির্ভর হয়ে গেছে।

সরকার যে উদ্দেশ্য নিয়ে ওয়েবসাইট ও অ্যাপ তৈরি করছে, তা ইতিবাচক উল্লেখ করে মইনুল হোসেন বলেন, ওয়েবসাইট ও অ্যাপ প্রতিনিয়ত হালনাগাদ করতে হয়। তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে চুক্তি শেষে এগুলো দেখভালের জন্য সরকারের সেই সক্ষমতা আছে কি না, তা-ও ভাবতে হবে।