‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ নামের এই ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি।
শহীদ মিনারের উন্মুক্ত পাদদেশে বহু রঙের থান কাপড় পেঁচিয়ে মঞ্চের নেপথ্য–কাঠামো তৈরি করা। তার সঙ্গে রেখাচিত্রে আঁকা বিভিন্ন জাতি–ধর্মের মানুষের মুখাকৃতি আটকে রাখা। তার সামনে এসে একে একে বিভিন্ন পরিবেশনায় অংশ নিচ্ছেন ম্রো, চাকমা, সমতলবাসী নারী ও পুরুষেরা। ধর্ম–বর্ণ–শ্রেণি–ভাষা–লিঙ্গ মিলেমিশে একাকার। পরিবেশনাতেও ছিল বিপুল বৈচিত্র্য। পরিবেশনার ফাঁকে ফাঁকে আলোচনা। সেখানেও উঠে এল সব ধরনের বৈষম্যের অবসান করে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক শক্তিশালী সমাজ গঠনের আহ্বান।
‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ নামের এই ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার প্রতিনিধিদের নিয়ে গত ২২ আগস্ট গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি গঠিত হয়। গতকাল শনিবার বিকেল সাড়ে চারটায় অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল সমবেত যন্ত্রবাদন দিয়ে। জাতীয় সংগীতের সুর পরিবেশন করেন যন্ত্রশিল্পীরা।
আলোচনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, বাংলাদেশ বহু জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ ও ভাষার দেশ। দেশ কেবল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ কারও নয়। প্রকৃতির মধ্যে বৈচিত্র্য আছে বলেই প্রকৃতি বিকশিত হয়েছে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করলেই সমাজ শক্তিশালী হবে। যে বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠনের জন্য ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থান করেছে। দেয়ালে দেয়ালে শিক্ষার্থীরা যেসব গ্রাফিতি এঁকেছেন, সেখানেও উঠে এসেছে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সব ধরনের বৈষম্যমুক্ত একটি সমাজ গঠনের আকাঙ্ক্ষা। তাই সবাই মিলে এ আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
প্রকৃতির মধ্যে বৈচিত্র্য আছে বলেই প্রকৃতি বিকশিত হয়েছে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করলেই সমাজ শক্তিশালী হবে। যে বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠনের জন্য ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থান করেছেআনু মুহাম্মদ, সাবেক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
অনুষ্ঠান থেকে নারায়ণগঞ্জের নরসিংহপুরে লালন সাঁইয়ের গানের আসর বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনার নিন্দা জানানো হয়।
আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে ছিল গান, আবৃত্তি, নাটক ও নৃত্য পরিবেশনা। প্রথমেই ম্রো ভাষায় নিজের লেখা ও সুর করা একটি প্রেমের গান গেয়ে শোনান মেনথাপ ম্রো।
রিকশাভ্যান ও ইজিবাইক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস বলেন, গণ–অভ্যুত্থানে ২৪ জন রিকশাচালক প্রাণ দিয়েছেন। তাঁদের নাম কোথাও নেই। অনেক রিকশাচালক আহত হয়েছেন। গোলাগুলির মধ্যে রিকশাচালকেরাই হতাহতদের হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। অথচ এখন তাদের রুটিরুজির ওপর আঘাত হানা হচ্ছে। তিনি প্রশ্ন করেন, এটা কি তাদের প্রতি বৈষম্য নয়? কে এই বৈষম্য দূর করবে?
এরপরে ‘ও দিদি গো খোকা হয়েছে নাকি খুকি হয়েছে’ গানের সঙ্গে ধ্রুপদি আঙ্গিকের নৃত্য পরিবেশন করেন আকরামুল হিজড়া। এই গানে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সামাজিক অবস্থান ও তাদের সংকট তুলে ধরা হয়। গণ–অভ্যুত্থানের ঘটনা নিয়ে আবার ফাল্গুন নাটক পরিবেশন করে নাট্যদল বটতলা।
‘আয়নাঘরের’ বন্দী মাইকেল চাকমা তাঁর বক্তব্যে বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের কথা বলা হলেও পাহাড়ি অঞ্চলে এখনো অঘোষিত সেনাশাসন চলছে। এর অবসান করতে হবে।
ট্রান্সজেন্ডার প্রতিনিধি জয়া শিকদার বলেন, বৈচিত্র্য আমরা এখনো মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। হিজড়া বা রূপান্তরকামী বা ট্রান্সজেন্ডার যে নামেই এই গোষ্ঠীকে ডাকা হোক না কেন, তার শরীর ও মনের জন্য তারা দায়ী নয়। সৃষ্টিকর্তা তাদের এভাবেই সৃষ্টি করেছেন। এই জনগোষ্ঠীকে সমাজ থেকে আলাদা করে না রেখে তাদের জনশক্তিতে রূপান্তর করার উদ্যোগ নিতে হবে।
শিল্পী ও লেখক অরূপ রাহী বলেন, ঔপনিবেশিক আমল থেকে সমাজে প্রচলিত ধারণাগুলো পরিবর্তন করতে হবে। ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতার মতো অনেক বিষয় নতুন করে বিবেচনা করতে হবে।
আন্দোলনে অংশ নিয়ে আহত হওয়া শিক্ষার্থী সাইফুদ্দিন মোহাম্মদ তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
এই আয়োজনের লক্ষ্য সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা বলেন, বাংলাদেশের সব ধর্ম জাতি লিঙ্গ শ্রেণি বয়স আর পেশা তথা নানা বৈচিত্র্যের মানুষেরা মিলেই ভয়ংকর অত্যাচারী দুর্নীতিবাজ লুটেরা হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়েছে। মানুষ জীবন দেবে অথচ কতিপয় গোষ্ঠী লুট করবে আর খবরদারি করবে এই অবস্থা আর চলতে দেওয়া যাবে না। দিকে দিকে আওয়াজ তুলুন: বৈষম্য, নিপীড়ন ও আধিপত্যমুক্ত সর্বজনের বাংলাদেশ চাই।
অনুষ্ঠানে আরও ছিল চাকমা শিল্পীদের ব্যান্ড ‘সংজোয়ার’–এর গান, দাদরা গান পরিবেশন করেন মিরঞ্জিল্লার শিল্পীরা। কাওয়ালি পরিবেশন করেন নাজিম কাওয়াল, লোকনৃত্য পরিবেশন করেন প্রিয়া খান। একক সংগীতে আরও ছিলেন কৃষ্ণকলি, কফিল আহমেদ, বাউল সুনীল কর্মকার, রামিসা চৌধুরী, ইভান তাহসিফ প্রমুখ। দর্শক সমাগম হয়েছিল প্রচুর। বেশ খানিকটা রাত অবধি তারা এই বৈচিত্র্যময় পরিবেশনা উপভোগ করেন।