আদালতের আদেশের পর ক্লাসে ফিরেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে আজীবন বহিষ্কৃত হওয়া শিক্ষার্থী আশিকুল ইসলাম ওরফে বিটু। কিন্তু বিষয়টি মেনে নিতে পারছে না শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ।
এর প্রতিবাদে আজ বুধবার ক্লাস বর্জন করেছেন বুয়েটের কয়েক শ শিক্ষার্থী। একই সঙ্গে আশিকুলের কোর্স নিবন্ধনসহ একাডেমিক কার্যক্রম বাতিলের দাবিতে তাঁরা আজ প্রায় ৩ ঘণ্টা উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করেন।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হলে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন শাখা ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী। এ ঘটনায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে প্রায় দুই মাস অচল ছিল বুয়েট। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন সহসম্পাদক (পরে বহিষ্কৃত) আশিকুলসহ ২৬ জনকে আজীবন বহিষ্কার করেছিল বুয়েট কর্তৃপক্ষ। তবে এই ঘটনায় হওয়া মামলা ও অভিযোগপত্রে আশিকুলের নাম ছিল না।
সম্প্রতি উচ্চ আদালত আশিকুলের বহিষ্কারাদেশের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। এরপরই তিনি কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ১৯তম ব্যাচের সঙ্গে ক্লাসে অংশ নেন। এর জেরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
আশিকুলের ক্লাসে ফেরার প্রতিবাদে গত সোমবার বিকেলে বুয়েট শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন একদল শিক্ষার্থী। গতকাল মঙ্গলবার বুয়েট ক্যাফেটেরিয়ার সামনে সংবাদ সম্মেলন করে ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান জানান তাঁরা। এরপর আজ বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ক্লাস বর্জন ও উপাচার্য সত্যপ্রসাদ মজুমদারের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন বুয়েটের কয়েক শ শিক্ষার্থী।
আজকের অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া বুয়েটের একাধিক শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, আশিকুলের কোর্স নিবন্ধনসহ একাডেমিক কার্যক্রম বাতিল না করা পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। এর অংশ হিসেবে আজ সকাল সাড়ে ১০টা থেকে তাঁরা উপাচার্য কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন।
দুপুর ১২টার দিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের চারজনের একটি দল উপাচার্যের কাছে দাবিদাওয়া জানাতে যায়। তারা বেলা একটার পর উপাচার্যের কার্যালয় থেকে বেরিয়ে আসে। পরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা উপাচার্য কার্যালয়ের সামনে থেকে উঠে ক্যাফেটেরিয়ার সামনে যান।
আবরার হত্যাকাণ্ডের পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৯ সালের অক্টোবরে বুয়েট ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে গত বছরের ১৪ আগস্ট ‘আলোচনা ও দোয়া’ অনুষ্ঠান করতে বুয়েটে গিয়েছিলেন শাখা ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা। তাঁরা কয়েক শ শিক্ষার্থীর তোপের মুখে পড়েন। ঘটনার পর বুয়েটের এই শিক্ষার্থীদের ‘জামায়াত-শিবির’ বলে আখ্যা দেন ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান। পরদিন জাতীয় শোক দিবসে বুয়েটের শহীদ মিনারে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দেন ছাত্রলীগের একদল কেন্দ্রীয় নেতা। সেখানে তাঁরা জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে স্লোগানও দেন।
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির বিষয়টি নতুন করে সামনে আসে গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে। বুয়েটের দুজন ছাত্র কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে স্থান পেলে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হন শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। বুয়েটের নীতিমালা ভঙ্গ, শিক্ষার শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ পরিবেশ বিনষ্টের অভিযোগে ওই দুই ছাত্রলীগ নেতার শাস্তি দাবি করেন তাঁরা।
এমন প্রেক্ষাপটে গত ৩০ জুলাই সন্ধ্যার দিকে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ‘ছাত্রশিবিরের’ সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে বুয়েটের প্রাক্তন-বর্তমান ৩৪ শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন সন্ত্রাসবিরোধী আইনে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়। গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের মুক্তি চেয়ে ২ আগস্ট বুয়েট শহীদ মিনারে সংবাদ সম্মেলন করেন তাঁদের অভিভাবক ও স্বজনেরা।
সংবাদ সম্মেলনের পরদিন ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে থাকা বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে একটি লিখিত বক্তব্য দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, কোনো অবস্থাতেই যেন ছাত্ররাজনীতি আবার বুয়েটে প্রবেশ করতে না পারে। একই সঙ্গে রোষানলের শিকার হয়ে কোনো নিরপরাধ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন যেন হুমকির মুখে না পড়ে।
৬ আগস্ট বুয়েটের শহীদ মিনারে ‘মৌলবাদের বিরুদ্ধে বুয়েট শিক্ষার্থীদের অবস্থান শীর্ষক কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ। কতিপয় শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা, স্বাধীনতাবিরোধী, উগ্রবাদী ও মৌলবাদী সংগঠন ছাত্রশিবিরের সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্ততার প্রতিবাদে ‘বুয়েটের সচেতন শিক্ষার্থীরা’ এই কর্মসূচি করেন।
এরপর আবরার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ‘জড়িত’ একজনের শ্রেণি কার্যক্রমে ফিরে আসার বিরুদ্ধে বুয়েট শিক্ষার্থীদের অন্য অংশের পক্ষ থেকে গত সোমবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়।
এর ধারাবাহিকতায় গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বুয়েট ক্যাফেটেরিয়ার সামনে সম্মিলিত শপথ পাঠ করেন কয়েক শ শিক্ষার্থী। শপথে ‘নৈতিকতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বৈষম্যমূলক অপসংস্কৃতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারকে সমূলে উৎপাটিত’ করার ঘোষণা দেওয়া হয়। শপথের পর সংবাদ সম্মেলনে ছাত্ররাজনীতি ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানের কথা জানান শিক্ষার্থীরা।