‘বিজয় এল, অথচ আমার ছেলে কিছু দেখল না’

গত ৪ আগস্ট উত্তরায় সড়কে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছে মাহিন (গোল চিহ্নিত)। কাছেই ছিলেন হেলমেট পরা অস্ত্রধারী ব্যক্তি। নিচে ইনসেটে গুলিবিদ্ধ মাহিনকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি। ঘটনাস্থলের ছবি তোলেন খালেদ সরকার
ছবি: কোলাজ

ধূসর চোখ আর বাদামি রঙের চুলের কারণে খুব সহজেই মাহিনকে আলাদা করা যেত। একবার বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে মায়ের অগোচরে কোন ফাঁকে বেরিয়ে চলে যাচ্ছিল হাইকোর্টের দিকে। এক পুলিশ সদস্য তাকে চিনতে পেরে ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন মায়ের কাছে। পাঁচ বছর বয়সে ছেলের সেই ‘হারিয়ে যাওয়ার’ গল্প বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন মা। বললেন, ‘শেষ পর্যন্ত ছেলে আমার হারিয়েই গেল।’

ছাত্র–জনতার আন্দোলন চলাকালে ৪ আগস্ট রাজধানীর উত্তরার আজমপুরে রাজউক কমার্শিয়াল কমপ্লেক্সের সামনে গুলিতে নিহত হয় আব্দুল্লাহ আল মাহিন (১৬) নামের এই কিশোর। তার পরিবার জানিয়েছে, একজন হেলমেটধারীর অস্ত্রের গুলিতে সে নিহত হয়।

জামিল হোসেন ও সামিরা জাহান দম্পতির একমাত্র সন্তান মাহিন। ২১ আগস্ট উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাহিনদের বাসায় গিয়ে কথা হয় তার শোকাহত মা–বাবার সঙ্গে। সেখানেই জন্ম নেওয়া মাহিন এলাকাবাসীর কাছে পরিচিত গানপাগল আর ফুটবলপ্রিয় হিসেবে। খেলাঘর, গীতাঞ্জলি একাডেমি নামের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল সে। তবে পরিবারের সদস্যদের কাছে তার শিশুতোষ একটি পরিচয় ছিল, সে ভৌতিক ঘরানার সিনেমা দেখে ‘ভূতের ভয়ে’ রাতে একা ঘুমাতে পারত না।

আব্দুল্লাহ আল মাহিন

‘ভীতু’ সেই ছেলেটা কীভাবে শিক্ষার্থী আন্দোলনে এতটা সাহসী হয়ে উঠল, সেই গল্পটা শোনা হলো মা, বাবা আর খালাতো বোনের কাছে। কক্ষের এক পাশে মাহিনের পড়ার টেবিল। বিছানার এক পাশে প্রিয় গিটার। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিচরণের স্বাক্ষর হিসেবে বেশ কিছু মেডেল ও ট্রফি রয়েছে তার।

সামিরা জাহানের বড় বোন আঞ্জুমান আরা বেগম ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর বোনের মেয়ে ফাতিমা আল তাজবীহ তাঁদের কাছেই বড় হচ্ছেন। শিশু একাডেমিতে ফাতিমাকে নাচ শেখাতে সামিরা নিয়ে যেতেন, সঙ্গে থাকত শিশু মাহিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাতিমা ছিলেন মাহিনের সবচেয়ে বড় বন্ধু। এমন কোনো ঘটনা নেই, যা বোনকে জানাত না।

মাহিনের বাবা জামিল হোসেন বলেন, তিনি জানতেনই না ছেলে বিক্ষোভে যেত। মারা যাওয়ার পর ছেলের মুঠোফোনে দেখেছেন মিছিলে যাওয়ার বিভিন্ন ভিডিও। জামিল হোসেন সিঙ্গাপুর ও লিবিয়ায় কাজে যুক্ত ছিলেন। ২০২০ সালে দেশে ফেরার পর আর যেতে পারেননি। এখন বাসার কাছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) স্থানীয় কার্যালয়ের পাশে একটি কম্পিউটার সেবাদানকারী দোকান রয়েছে।

বিআরটিএ কার্যালয় থেকে একটি সরু গলি পেরিয়ে মাহিনদের ভাড়া বাসা। মধ্যরাতে মাহিনের মরদেহ আসার পর এলাকাবাসীর ঢল নেমেছিল। মাহিনের প্রতি ভালোবাসার ঝলক দেখা যায় দেয়ালজুড়ে, এমনকি গুগল ম্যাপেও। দেয়ালে মাহিনের মৃত্যুর দিনটিকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘৩৫ জুলাই’ হিসেবে। দিয়াবাড়িতে মেট্রোরেল স্টেশনের কাছের চত্বরটিকে গুগল ম্যাপে কেউ একজন ‘শহীদ আব্দুল্লাহ আল মাহিন চত্বর’ নামে যুক্ত করেছেন।

সেদিন তাড়াহুড়া করে বের হয় মাহিন

দিয়াবাড়ি মডেল হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করে মাহিন ভর্তি হয় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে (এনআইইটি)। মা সামিরা বললেন, মাহিন বলত, সে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বিদেশে চলে যাবে। কিন্তু আন্দোলন শুরুর পর সে ভিন্ন সুরে কথা বলত। আন্দোলনে যেতে তিনি বাধা দিতেন বলে একদিন বলল, ‘মা, আমার বড় ভাইরা মরে যাচ্ছে। তুমি যেতে দিতে চাও না কেন? অনেক মা–বাবা ছেলেমেয়েদের নিয়ে মিছিলে আসে। আমাকে যেতে বাধা দিয়ো না। এভাবে বাসায় বসে থাকলে আমরা কিছু পাব না। চাকরিও পাব না। এর চেয়ে রাস্তায় গিয়ে মিছিল করে মরে যাওয়া ভালো।’

মাহিনের নামে গুগল মানচিত্রে এই চত্বরটির নামকরণ করেছেন কেউ

মা জানান, ঘটনার দিন ৪ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে ঘুম থেকে উঠে ফোনে কিছু একটা দেখে দ্রুত মাকে নাশতা দিতে বলে মাহিন। এরপর নাশতা না খেয়ে শুধু একটা ডিম সিদ্ধ দুই কামড়ে মুখে পুরে পানি দিয়ে গিলে তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে যায়। আধঘণ্টা পর মাহিনের বাবা বাসায় ফিরলে তিনি ঘটনা শুনে মাহিনের মুঠোফোনে কল দেন। অন্য একজন ফোন ধরে জানান, ‘মাহিন গুলি খেয়েছে’।

গুলির খবর শুনে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে মাহিনের বাবা দেখেন, হাসপাতালের নার্স–চিকিৎসকেরা মাহিনের রক্ত মুছছেন আর কাঁদছেন। একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে মাহিনকে নিয়ে পৌঁছান তাঁরা। রাত সাড়ে নয়টায় হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) মারা যায় মাহিন। কিশোর মাহিনকে সমাহিত করা হয়েছে দাদাবাড়ি ময়মনসিংহ শহরের পুরোহিতপাড়ায়।

উত্তরার দিয়াবাড়ির বাসায় মাহিনের বাবা, মা আর খালাতো বোন

কাছ থেকে দুটি গুলি করা হয়

মাহিনের বাবা জামিল হোসেন প্রথম আলো অনলাইনের একটি ছবি দেখান এই প্রতিবেদককে। ছবিতে দেখা যায়, দুজন মানুষ রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। এর একজন মাহিন। কাছাকাছি দাঁড়ানো সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের লোকজন। কারও হাতে লাঠি, সবুজ জার্সি গায়ে হেলমেট মাথায় একজনের হাতে অস্ত্র।

জামিল বলেন, প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে শুনেছেন, অস্ত্র হাতে দাঁড়ানো ব্যক্তি খুব কাছ থেকে গুলি করেছেন দুজনকে। প্রথম গুলি মাহিনের বাঁ চোখে লাগে। মাহিন চোখে হাত দিয়ে ঘুরে বসে পড়লে ওর মাথার পেছনে আরেকটা গুলি করা হয়। প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ছবি (একজন শিক্ষার্থী রক্তাক্ত এক কিশোরকে কোলে নিয়ে ছুটছেন) দেখিয়ে জামিল হোসেন বলেন, রক্তাক্ত কিশোরটি তাঁর ছেলে মাহিন। আওয়ামী লীগের ওই কর্মীরা সরে যাওয়ার পর রাস্তা থেকে কোলে করে মাহিনকে হাসপাতালে নেন ওই শিক্ষার্থী। মাহিনকে যিনি গুলি করেছেন এবং যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁদের এলাকাবাসী চেনেন। এলাকার সাবেক সংসদ সদস্যের বাহিনী। জামিল হোসেন জোর গলায় বললেন, তিনি ছেলে হত্যার বিচার চান। মামলা করতে চান।

ছয় ফুট উচ্চতার মাহিনকে ‘বড় মানুষ’–এর মতো দেখাত বলে মা প্রায়ই খ্যাপানোর জন্য বলতেন, ‘তোকে বিয়ে দিয়ে দেব।’ এখন মাহিনবিহীন শূন্য ঘরে সেই সব দিনের কথা খুব মনে পড়ে। হাহাকার নিয়ে মা সামিরা জাহান বললেন, ‘আর মাত্র এক দিন পরই (৫ আগস্ট) বিজয় এল। আমার ছেলেটা সেদিন বেঁচে গেলেই আজ বেঁচে থাকত। বিজয় এল, অথচ আমার ছেলে কিছু দেখল না।’