জনপ্রশাসন

পদ নেই, কাজও আগের, তবু তাঁদের পদোন্নতি

প্রশাসন ও পুলিশে দ্রুত পদোন্নতি হয়। প্রশাসনে পদোন্নতি পেলেও দায়িত্ব পালন করতে হয় আগের পদেই। ব্যয় বাড়ছে সরকারের।

জনপ্রশাসনে যুগ্ম সচিবের পদ আছে সব মিলিয়ে ৫০২টি। যদিও এই পদের বিপরীতে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তা রয়েছেন ৭১৭ জন। নতুন করে পদোন্নতির প্রক্রিয়াও চলছে।

যুগ্ম সচিব পদের মতো অতিরিক্ত সচিব ও উপসচিব পদেও পদসংখ্যার চেয়ে কর্মকর্তা বেশি। পদ না থাকলেও পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তারা যে বাড়তি দায়িত্ব অথবা আগের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন, তা নয়। বহু ক্ষেত্রে পদোন্নতির পরও তাঁদের দিয়ে করানো হচ্ছে আগের কাজই। অর্থাৎ বড় কর্মকর্তারা এক ধাপ নিচের পদের কাজ করেন। পদোন্নতির ফলে শুধু তাঁদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা বাড়ে। ফলে ব্যয় বেড়ে যায় সরকারের।

সরকার ২০২২-২৩ অর্থবছরের যে বাজেট দিয়েছে, তাতে দেশের সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও পেনশনে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মোট বাজেটের ২৫ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ সরকার পুরো দেশের জন্য যে বাজেট করেছে, তার প্রতি ১০০ টাকা ব্যয়ের ২৫ টাকার বেশি যাচ্ছে সরকারের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও পেনশন সুবিধায়।

সরকার হয়তো মনে করে প্রশাসন ও পুলিশ তাদের বেশি কাজে আসে। অনেক সময়ই সরকার প্রশাসন ও পুলিশের প্রতি নির্ভরশীল হয়। কিন্তু যেকোনো পদোন্নতির ক্ষেত্রে পদ ও যোগ্যতার বিষয়টি বেশি প্রাধান্য পাওয়া উচিত।
অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান, জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ

সরকারের সব ধরনের চাকরিতে এভাবে পদোন্নতি হয় না। অভিযোগ আছে, প্রশাসন, পুলিশ ও পররাষ্ট্র ক্যাডারে দ্রুত পদোন্নতি হয়। অন্য ক্যাডারে বছরের পর বছর কর্মকর্তারা পদোন্নতির আশায় বসে থাকেন।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন অবশ্য পদোন্নতির পক্ষে কিছু যুক্তি তুলে ধরেছেন। যুগ্ম সচিব পদে নতুন করে পদোন্নতি দেওয়ার প্রক্রিয়ার কথা জানাতে গিয়ে সম্প্রতি তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কর্মকর্তারা অবসরে যাওয়ায় প্রতিনিয়তই ওপরের পদগুলোতে জনবল কমতে থাকে। আর
যুগ্ম সচিব পদটি বেশি প্রয়োজন। প্রকল্পসহ সরকারের কাজও বেড়েছে। এ জন্য যুগ্ম সচিব পদে অন্তত ১০০ জনের মতো বেশি জনবল রাখতে হয়। কারণ, অনেকে শিক্ষাছুটিতে থাকেন, অসুস্থ থাকেন।

অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাস্তবতা আসলে ভিন্ন। পদোন্নতি দিয়ে যথোপযুক্ত কাজ দিতে না পেরে সরকার কর্মকর্তাদের নিচের পদে দায়িত্বে রাখে। প্রয়োজন না থাকলেও পদোন্নতি দেওয়া হয় আমলাদের খুশি রাখতে।

জনপ্রশাসনের কাঠামো এখন ‘পেটমোটা’

বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে ২৬টি ক্যাডারে নিয়োগ দেওয়া হয়।

জনপ্রশাসন নিয়ে গবেষণা করেন বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (পিএটিসি) সাবেক রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে জানান, দেশে জনপ্রশাসনের এখন যে কাঠামো রয়েছে, তা গড়ে তুলেছিল ব্রিটিশরা। এই কাঠামো পিরামিড আকৃতির, অর্থাৎ ওপরের স্তরে কর্মকর্তা কম থাকবেন, নিচের দিকে বেশি থাকবেন। এতে নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত হবে। তিনি আরও বলেন, এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো আমলাতন্ত্র এখন সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভুটানে রয়েছে। তারা পিরামিড আকৃতি বজায় রেখেছে। বাংলাদেশের জনপ্রশাসনের কাঠামো এখন ‘পেটমোটা’ হয়ে গেছে। তাঁর জানামতে, এমন ‘পেটমোটা’ কাঠামোর প্রশাসন আর কোথাও নেই।

বাংলাদেশের প্রশাসনের কাঠামো ‘পেটমোটা’ হয়েছে পদ ছাড়া পদোন্নতির কারণে। উল্লেখ্য, জনপ্রশাসনের পদ ছয়টি স্তরের। এর মধ্যে শুরুর পদটি সহকারী সচিব (মাঠ প্রশাসনে সহকারী কমিশনার)। এরপর ধারাবাহিকভাবে ওপরের পদগুলো হলো জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব, উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গত শনিবারের হিসাব অনুযায়ী, জনপ্রশাসনে মোট কর্মকর্তা ৫ হাজার ৯৭১ জন। বর্তমানে অতিরিক্ত সচিবের নিয়মিত পদ আছে ২১২টি। এর সঙ্গে সমপর্যায়ের বিভিন্ন দপ্তরে প্রেষণে (নির্ধারিত পদের বাইরে অন্যান্য দপ্তর বা সংস্থায় নিয়োগ) থাকা পদ আছে আরও প্রায় ১২৫টির মতো। সব মিলিয়েও অতিরিক্ত সচিবের পদ দাঁড়ায় ৩৩৭টিতে। কিন্তু ১ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মরত অতিরিক্ত সচিব ছিলেন ৪৩৩ জন। অর্থাৎ পদের চেয়ে ৯৬ জন অতিরিক্ত সচিব বেশি।

যুগ্ম সচিবের মোট পদের চেয়ে কর্মকর্তা বেশি ২১৫ জন। আর এখন উপসচিব আছেন ১ হাজার ৬৩৬ জন। এই পদে কার্যত নিয়মিত পদ আছে হাজারখানেক। যদিও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, সারা দেশে সমপর্যায়ের পদগুলো মিলিয়ে উপসচিব বা সমপর্যায়ের পদ আছে ১ হাজার ৭৫০টি। উল্লেখ্য, উপসচিব থেকে পদগুলো আর একক কোনো ক্যাডারের থাকে না। এই পদে ৭৫ শতাংশ পদোন্নতি হয় প্রশাসন ক্যাডার থেকে এবং ২৫ শতাংশ পদোন্নতি হয় অন্যান্য ক্যাডার ছেড়ে আসা কর্মকর্তাদের। এদিকে উপসচিব পদে নতুন করে পদোন্নতির প্রক্রিয়া চলছে।

বর্তমানে জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব আছেন ১ হাজার ৮৯৫ জন এবং সহকারী সচিব আছেন ১ হাজার ১৯৬ জন। অর্থাৎ চাকরির শুরুর পদে কর্মকর্তা তুলনামূলক কম।

জ্যেষ্ঠ (সিনিয়র) সচিবসহ বর্তমানে ৭৬ জন সচিব এবং ১৮ জন গ্রেড-১–এর কর্মকর্তা আছেন।

১৯৭৯ ব্যাচে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেওয়া ২৩ কর্মকর্তার উদাহরণ দিয়ে আবদুল আউয়াল মজুমদার বলছিলেন, এত কমসংখ্যক কর্মকর্তার পদোন্নতি পেয়ে উপসচিব হতে সময় লেগেছিল প্রায় ১৯ বছর। কারণ, ওপরের পদ খালি না হওয়ায় তাঁরা পদোন্নতি পাননি। এখন প্রশাসন ক্যাডারে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয় বেশি। পদ না থাকলেও পদোন্নতি হয় দ্রুত।

পুলিশ ক্যাডারের ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তারাও দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হয়ে তৃতীয় গ্রেডের সুবিধা পাচ্ছেন। এমনকি ২৪তম বিসিএসের কয়েকজন কর্মকর্তাও পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি) পদে পদোন্নতি পেয়েছেন।

এ ছাড়া ২৭তম বিসিএসের কর্মকর্তারাও এক বছরের বেশি আগে পুলিশ সুপার (এসপি) পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। সর্বশেষ কিছুদিন আগে পুলিশের ২৮তম ব্যাচের ২৫ জন কর্মকর্তা এসপি পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। যদিও তাঁদের এখনো নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।

কাজ নিচের পদে

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, পদ না থাকলেও পদোন্নতির এই প্রবণতা চলছে মোটামুটি এক যুগ ধরে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা বেড়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১২ সালে প্রশাসনে জ্যেষ্ঠ সচিব পদ তৈরি করা হয়। সচিবদের মধ্যে জ্যেষ্ঠদের এই মর্যাদা দেওয়া হয়।

পদোন্নতি দিয়ে যে আগের কাজই করানো হয়, তার উদাহরণ অনেক। গত ২৯ জুন সরকার ৮২ জন উপসচিবকে পদোন্নতি দিয়ে যুগ্ম সচিব করেছে। কিন্তু প্রায় সবাই আগের পদে অর্থাৎ উপসচিব থাকার সময়ে যে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন, সেই দায়িত্বেই রয়েছেন। নিয়মিত পদ না থাকায় অনেককেই আগে যেসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ছিলেন, সেসব জায়গায় ‘সংযুক্ত’ হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে।

আগে মন্ত্রণালয়ের অধিশাখার দায়িত্বে থাকতেন যুগ্ম সচিবেরা। কিন্তু এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত সচিবেরা এই পদে দায়িত্ব পালন করছেন। অবশ্য অধিশাখার দায়িত্ব এখন অতিরিক্ত বা যুগ্ম সচিবের সমমান করা হয়েছে।

আরেকটি দিক হলো, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানেও প্রেষণে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, ওই দায়িত্ব পালনের কথা বিশেষায়িত কর্মকর্তাদের। যেমন বিমা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে চারজন যুগ্ম সচিব ও তিনজন উপসচিবকে প্রেষণে নিয়োগ দিয়েছে সরকার।

পদোন্নতির সুযোগ-সুবিধা

পদোন্নতি পাওয়ার পর কর্মকর্তারা আর্থিক সুবিধা, পদমর্যাদাসহ আরও বেশ কিছু সুবিধা পান। যুগ্ম সচিব পদটিকে সরকারের নীতিনির্ধারণী পদ হিসেবে দেখা হয়। যুগ্ম সচিব হলে কর্মকর্তাদের বেতন দুই ধাপ বেড়ে পঞ্চম গ্রেড থেকে তৃতীয় গ্রেডে উন্নীত হয়। এই গ্রেডের কর্মকর্তাদের মূল বেতন শুরু হয় ৫৫ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে, যা বাড়তে বাড়তে ৭৪ হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত হওয়ার সুযোগ আছে। এর সঙ্গে বাড়িভাড়া ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা তো আছেই। যুগ্ম সচিবেরা সরকারি গাড়ির সুবিধাও পান। সরকারি পরিবহন পুল থেকে গাড়ি না পেলে তাঁদের বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ৩০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে গাড়ির চালক, জ্বালানিসহ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি মাসে ৪৫ হাজার টাকা পান তাঁরা।

উপসচিব পদে আগে পদোন্নতির পরপরই গাড়ির সুবিধা দেওয়ার নিয়ম ছিল। পরে সেটি পরিবর্তন করে বলা হয়, উপসচিব হওয়ার অন্তত তিন বছর পর গাড়ির সুবিধা দেওয়া হবে। উপসচিবেরা পঞ্চম গ্রেডে বেতন পান। এই গ্রেডে মূল বেতন শুরু হয় ৫০ হাজার টাকা দিয়ে, যা ৬৯ হাজার ৮৫০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।

অতিরিক্ত সচিবেরা বেতন পান দ্বিতীয় গ্রেডে, যাঁর মূল বেতন শুরু হয় ৬৬ হাজার টাকা দিয়ে এবং শেষ ধাপ ৭৬ হাজার ৪৯০ টাকা। এর সঙ্গে বাড়ি ভাড়া এবং গাড়ির সুবিধাসহ আরও কিছু আনুষঙ্গিক সুবিধাও পান। সচিব ও গ্রেড-১ প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মূল বেতন ৭৮ হাজার টাকা। তবে জ্যেষ্ঠ সচিবদের মূল বেতন ৮২ হাজার টাকা। মূল বেতনের সঙ্গে বাড়িভাড়া ও অন্যান্য ভাতা রয়েছে।

অবশ্য কর্মকর্তারা বলছেন, যোগ্যতা থাকলে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের অধিকার। পদোন্নতি না পেলে কর্মস্পৃহা কমে যায়। এ বিষয়ে ভিন্নমত হলো, পদোন্নতি অধিকার শুধু পদ থাকলে। পদের বাইরে পদোন্নতি অধিকার নয়।

এদিকে এখন বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে রাখার ঘটনা আগের চেয়ে কমেছে। আগে রাজনৈতিক বিবেচনায় অসংখ্য কর্মকর্তাকে ওএসডি করে রাখার অভিযোগ ছিল। তবে প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এখনো আছে। গত ১ আগস্ট পর্যন্ত প্রশাসনে ১৭ জন কর্মকর্তা চুক্তিতে ছিলেন।

সার্বিক বিষয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি নীতিমালায় গলদ নেই। গলদটি হলো অঙ্গীকারে। প্রশাসন ও পুলিশের কর্মপরিধি বড়। সরকার হয়তো মনে করে প্রশাসন ও পুলিশ তাদের বেশি কাজে আসে। অনেক সময়ই সরকার প্রশাসন ও পুলিশের প্রতি নির্ভরশীল হয়। কিন্তু যেকোনো পদোন্নতির ক্ষেত্রে পদ ও যোগ্যতার বিষয়টি বেশি প্রাধান্য পাওয়া উচিত।