১৩-১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি

সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণায় উঠে এসেছে এসব তথ্য

আত্মহত্যা
প্রতীকী ছবি

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে আত্মহত্যা করেছেন মোট ৩৬১ জন শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি।

সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণায় উঠে এসেছে এসব তথ্য। গবেষণায় দেখা যায়, আত্মহত্যাকারীদের বয়সের বিবেচনায় ৬৭ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী ছিল এই ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী। তাদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ১৫৯ জন এবং পুরুষ শিক্ষার্থী ৮৪ জন।

আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণায় পাওয়া এই ২৪৩ জনের মধ্যে স্কুলশিক্ষার্থী ১৬৯ জন। ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২১ দশমিক ৬; আর আত্মহত্যার বড় কারণ অভিমান।

১ সেপ্টেম্বর আত্মহত্যা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী কাজী সামিতা আশকা। তাঁর  বাবা কাজী শাফিউল আজম প্রথম আলোকে বলেন ‘আমার মেয়ে আত্মহত্যা করার মতো দুর্বল মানসিকতার ছিল না। এমন কোনো প্রবণতাই ওর ছিল না। সব সময় পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। এর মধ্যেও এমন ঘটনা ঘটল। যদিও সন্তান দূরে ছিল, তবে আমাদের হয়তো আরও বেশি সংযোগ প্রয়োজন ছিল সন্তানের সঙ্গে।’

দেশের ১০৫টি জাতীয়, স্থানীয় পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টাল থেকে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার তথ্য সংগ্রহ করেছে আঁচল ফাউন্ডেশন। তাঁরা তাদের গবেষণায় বলছে, অভিমানে আত্মহত্যা করেছে ৩১ দশমিক ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া আত্মহত্যার পেছনে প্রেমঘটিত সমস্যা, পারিবারিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, পড়ালেখার চাপ, মানসিক অস্থিরতাসহ অন্যান্য কারণ উঠে এসেছে।

আজ ১০ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে আঁচল ফাউন্ডেশন গতকাল শনিবার আয়োজন করে ‘শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ক্রমবর্ধমান: কোন পথে সমাধান?’  শীর্ষক সমীক্ষার। এতে অংশ নিয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যতজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন, এর জন্য আমাদের উচিত তাঁদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগী হওয়া। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পরিবারের সদস্যদের এবং শিক্ষকদের নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দায়িত্বশীল হতে হবে, যেন তাঁরা শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে যত্নবান হতে পারেন।’

তবে বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের মধ্যে বোঝার ঘাটতি থাকার কথা উঠে আসে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি ফরিদা ইয়াসমিনের বক্তব্যে। ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, সংবেদনশীলভাবে শিক্ষার্থীদের বোঝানোর দক্ষতায় শিক্ষকদের ঘাটতি আছে। এ ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি পরিবারের পক্ষ থেকেও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। সব সময় সন্তানের ভুল না ধরে, চাপ প্রয়োগ না করে, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা বুঝতে চাওয়া উচিত।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার চিকিৎসক মো. শহীদুল ইসলাম জানান,  আগামী অর্থবছর থেকে বাস্তবায়নযোগ্য পঞ্চম এইচপিএনএসপি সেক্টর প্রোগ্রামের আওতায় সরকার প্রথমবারের মতো একটি ডেডিকেটেড অপারেশনাল প্ল্যান ‘মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড ডিজঅ্যাবিলিটি (এমএইচডি)’ অনুমোদন করতে যাচ্ছে। যেখানে আগামী পাঁচ বছরের মানসিক স্বাস্থ্যের অন্তর্ভুক্ত আত্মহত্যা ও এর চেষ্টা প্রতিরোধে অত্যাধুনিক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনা হাতে নেওয়া হচ্ছে।

এ সময় জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসক নিয়োগ এবং সেখানকার চিকিৎসকদের মনোবিজ্ঞান বিষয়ে প্রশিক্ষণের গুরুত্বের কথা উঠে আসে।
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট তানসেন রোজ আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেন, বড় ভূমিকা রাখছে অভিমান। পরিবারের সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্ক কতটুকু মজবুত, তা নিয়ে চিন্তার উদ্রেক করে। গত বছর আত্মহত্যার পেছনে করোনা একটি বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিল। এ বছর করোনা না থাকলেও আত্মহত্যার সংখ্যায় খুব একটা হেরফের হয়নি।

সমীক্ষা উপস্থাপন থেকে উঠে আসে আত্মহত্যা প্রতিরোধে ১০টি প্রস্তাব। এর মধ্যে রয়েছে আত্মহত্যা মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দ্রুত ও সহজলভ্য করতে একটি টোল ফ্রি জাতীয় হটলাইন নম্বর চালু করা, পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আবেগীয় অনুভূতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল ও ধৈর্যশীলতার পাঠ শেখানো, শিক্ষার্থীদের নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবিলা করার কৌশল, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট এবং মানসিক বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে শেখানোর কথা।

আলোচকেরা গণমাধ্যমের দায়িত্ব নিয়েও কথা বলেন। গণমাধ্যমে দায়িত্বপূর্ণ প্রতিবেদন লেখা ও প্রকাশ করা এবং যথাসম্ভব আত্মহত্যার বিস্তারিত বিবরণ ও ধরন বর্ণনা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তাঁরা।