‘এসব মৃত্যু আমাদের সবার জন্যই দুঃখজনক’—বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। এক রিটের শুনানিতে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসাইন দোলনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার এই মন্তব্য করেন।
শুনানির শুরুতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে নারায়ণগঞ্জে বাসার ছাদে ছয় বছরের শিশু রিয়ার মৃত্যু নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন তুলে ধরেন রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী অনীক আর হক। একপর্যায়ে আদালত বলেন, ‘এসব মৃত্যু আমাদের সবার জন্যই দুঃখজনক।’
তখন অনীক আর হক বলেন, ‘একটা জীবন যখন চলে যায়, তখন কোনো পক্ষ থাকে না। ছয় বছরের শিশু...।’ এই আইনজীবীর উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘আমরা কোর্টে ইমোশনাল বিষয় অ্যাড্রেস করব না। আমরা খুব লজ্জিত।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘কথিত আটক’ ছয় সমন্বয়ককে মুক্তি দিতে ও দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী গুলি না চালাতে নির্দেশনা চেয়ে গত সোমবার রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী। তাঁরা হলেন আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন ও আইনুন্নাহার সিদ্দিকা। রিটের ওপর গত সোমবার ও গতকাল মঙ্গলবার শুনানি হয়।
গতকাল সকাল ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে শুনানি শুরু হয়, চলে বেলা ১টা পর্যন্ত। শুনানি চলার সময় রাষ্ট্রপক্ষ ও রিট আবেদনের সমর্থকদের মধ্যে কয়েক দফা হইচই হয়। এমন প্রেক্ষাপটে আইনজীবীদের উদ্দেশে একাধিকবার আদালত বলেন, ‘আপনারা শান্ত থাকুন। আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করতে দিন।’
শুনানিতে পুলিশ প্রবিধানের (পিআরবি) বিভিন্ন বিধান তুলে ধরেন অনীক আর হক। একপর্যায়ে আদালত বলেন, পাঁচ ধরনের বিচারব্যবস্থা আছে। কলোনিয়াল বিচারব্যবস্থায় কমন ল ভুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে পুলিশ কী আচরণ করবে, তা পিআরবিতে বলা আছে। একপর্যায়ে অনীক আর হক বলেন, বিটিভি ভবন পোড়ানো, মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে যখন হামলা হয়েছে, সেখানে একটি গুলিও চলেনি, সেখানে কেউ মারা যায়নি। মিছিলে গুলি চালানো হয়েছে। কখন, কোথায়, কীভাবে গুলি করা যাবে, তা পিআরবিতে বলা আছে। চরম পরিস্থিতিতে গুলি করা যাবে।
আদালত বলেন, চরম ও স্বাভাবিক—এটি ঘটনাগত প্রশ্নের বিষয়। অনীক আর হক বলেন, ‘আমরা বলছি না যে পুলিশ কাজ করবে না।’ একপর্যায়ে আদালত বলেন, এমন কোনো কাজ করা ঠিক হবে না যাতে জাতির ক্ষতি হয়। তখন অনীক আর হক বলেন, জাতির ক্ষতি বলতে শুধু স্থাপনাই নয়, মানুষের জীবনও আছে। আদালত বলেন, জীবন-সম্পত্তি সবই।
অনীক আর হক বলেন, প্রাণঘাতী গুলি প্রথমেই যেন না চালানো হয়। একসময় গরম পানি দিয়ে, মরিচের গুঁড়া ও টিয়ার গ্যাস মারা হতো। আদালত বলেন, জানমালের নিরাপত্তায় পুলিশ রাবার বুলেট মারে, এরপর সিসা ব্যবহার করে। এতে কাজ না হলে মাইকে ঘোষণা দিয়ে গুলি করে। অনীক আর হক বলেন, এটি প্রক্রিয়া। অবশ্যই পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করবে। একপর্যায়ে আদালত বলেন, প্রবিধানে প্রক্রিয়া সব বলা আছে। সংবিধান অনুসারে দায়িত্ব পালন করা হচ্ছে না।
রিটের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ছয়জনকে বেআইনিভাবে অথবা আইনবহির্ভূত রাখা হয়নি, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। আইনগত ক্ষমতার বাইরে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায় না। বলা হচ্ছে আটকাদেশ নেই। শিক্ষকেরা দেখা করতে গেছেন, দেখা করতে দেওয়া হয়নি। মানে নিয়ন্ত্রণের একটা ব্যাপার আছে।
আদালতে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, রিট আবেদনকারীরা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। ছয়জন সমন্বয়ক ডিবি হেফাজতে রাখার অভিযোগ নিয়ে এসেছেন তাঁরা। এখানে ছয়জনের নিরাপত্তার বিষয়। তাঁদের যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে…।
তখন আদালত বলেন, প্রক্রিয়ার ভেতরে আটকে রাখতে হবে, প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখা হয়নি। গ্রেপ্তার করলে আদালতে হাজির করতে হবে। এ সময় নূরুল ইসলাম বলেন, তাঁদের নিরাপত্তার জন্যই। তখন আদালত বলেন, যাঁদের নিয়েছেন, তাঁরা তো নিরাপত্তা চাননি। এরপর নূরুল ইসলাম বলেন, তাঁরা চেয়েছেন।
শিশুর মৃত্যুর (নারায়ণগঞ্জে বাসার ছাদে গুলিবিদ্ধ) যে ঘটনাটি উপস্থাপন করা হয়েছে, তা দুঃখজনক উল্লেখ করে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনীর শুনানিতে বলেন, সরকার বা পুলিশের জন্য শিশুটি মারা গেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই।
আরেকজন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, মুগ্ধ নামের একজন সমন্বয়ক বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন আন্দোলনে দুর্বৃত্তরা ঢুকে গেছে। পরে তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে ছয় সমন্বয়কে নিরাপত্তা দিচ্ছে ডিবি।
অপর অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বলপ্রয়োগ করেছে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রিটে উল্লেখ নেই।
শুনানি নিয়ে আদালত আজ বুধবার পরবর্তী দিন রাখেন। এর আগে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, আজহার উল্লাহ ভূঁইয়া ও শাহ মঞ্জুরুল হক বক্তব্য তুলে ধরেন। রাতে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, বুধবারের কার্যতালিকায় রিটটি আদেশের জন্য ১০ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে।