দিনাজপুর হর্টিকালচার সেন্টারে ফোটা পয়েনসেটিয়া
দিনাজপুর হর্টিকালচার সেন্টারে ফোটা পয়েনসেটিয়া

লালে লাল লালপাতা

যেকোনো গাছের সবচেয়ে সুন্দর অংশ হলো ফুল। কিন্তু পয়েনসেটিয়া গাছের সৌন্দর্য হলো তার পাতাসদৃশ অঙ্গে। পয়েনসেটিয়া বা পত্রমঞ্জরির পাতায় পাতায় লেখা হয় সুন্দরের কবিতা। শীতের আবেশে সে সেজে ওঠে শিশিরের হীরক কণায়। আহা কী অপূর্ব তার রূপ! একই গাছে পাতার এমন সবুজ আর টকটকে লালের রূপ! গত বছর দিনাজপুর হর্টিকালচার সেন্টারে শিশিরমাখা এক শীতের সকালে পয়েনসেটিয়ার সে রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। গাছের মাথায় থোকা ধরা গুচ্ছবদ্ধ লাল পাতাসদৃশ অঙ্গগুলো ফুলের মঞ্জরির মতো চারদিকে ছড়িয়ে থাকে বলেই এর নাম দেওয়া হয়েছে পত্রমঞ্জরি। নামটা ভারতীয় বাঙালিদের, আমাদের দেশে এর নাম লালপাতা। পয়েনসেটিয়ার লাল অঙ্গগুলোকে আমরা অনেকেই পাতা বলে মনে করি, ভুলটা ওখানেই। ডালের আগায় চারদিকে ছড়িয়ে যে পাতার মতো লাল অঙ্গগুলো ছড়িয়ে থাকে, সেগুলো আসলে পাতা নয়, ফুলের অংশ বৃতি। ফুল ফোটে ছোট থোকা ধরে তার মধ্যখানে, ফুলও খুব ছোট্ট, ফুল প্রায় দেখাই যায় না। 

প্রাচীন অ্যাজটেক সভ্যতায়ও এ ফুলের কদর ছিল বলে জানা যায়। সে যুগে তারা পয়েনসেটিয়া গাছের ব্যবহার করতেন প্রাকৃতিক লাল রং উৎপাদন ও চিকিৎসার কাজে। পৃথিবীতে অ্যাজটেকবাসীরাই পয়েনসেটিয়া প্রথম চাষ করেন, এর আগে গাছটা ছিল বুনো। মেক্সিকো ও গুয়াতেমালায় পয়েনসেটিয়াকে ডাকা হয় ‘ক্রিসমাস ইভ ফ্লাওয়ার’ নামে। তার মানে ডিসেম্বরের সঙ্গে এর ফুল ফোটার একটা সম্পর্ক আছে। ক্রিসমাসের পুষ্পসজ্জায় পয়েনসেটিয়া ইউরোপ-আমেরিকায় যেন অপরিহার্য। কি বাড়ি, কি হোটেল-রেস্তোরাঁ—সবখানেই পয়েনসেটিয়ার বাহারি বিচরণ দেখা যায় ক্রিসমাসের দিনগুলোতে। লোকঐতিহ্য ও জনপ্রিয়তায় ক্রিসমাসের ফুলসজ্জায় সারা বিশ্বে পয়েনসেটিয়া এক নম্বর। ক্রিসমাসের ফুলসজ্জায় জনপ্রিয় আরও দুটি ফুল হলো অ্যামারিলিস লিলি ও ক্রিসমাস ক্যাকটাস। 

গাছটির আদিনিবাস মেক্সিকো ও দক্ষিণ আমেরিকা হলেও সে এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিশ্বজুড়ে, ফুলপ্রেমীদের বাগানে বাগানে, এমনকি পার্কেও। ঢাকায় রমনা পার্কেও আছে এ গাছ। এখন আর তার সেই আদিরূপ নেই। উদ্ভিদ জাতবিদদের খপ্পরে পড়ে সংকরায়িত হয়ে অনেক চমৎকার চেহারার কিছু হাইব্রিড জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। এর টকটকে লাল রং দেখতে দেখতে যাঁরা একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, তাঁরা সেই বৈচিত্র্যের স্বাদ নিতে হালকা গোলাপি, ম্যাটমেটে লাল বা কুঁচকানো পাতার পয়েনসেটিয়াকে প্রাঙ্গণে টেনে এনেছেন। বিশ্বে এখন প্রায় ১০০ জাতের পয়েনসেটিয়া আছে, আছে সাদা রঙের পয়েনসেটিয়াও। পয়েনসেটিয়ার এরূপ বেশ কিছু বিদেশি হাইব্রিড জাতের দেখা পেয়েছিলাম গত বছরের নভেম্বরে সাভারে বরিশাল নার্সারিতে। তাঁরা বলেছিলেন, গাছগুলো দেশের নয়। ব্যবসার উদ্দেশ্যে ওগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে। তবে আশা করেছেন, তাঁরা অচিরেই এর ডাল থেকে নতুন চারা তৈরি করতে পারবেন। তবে অতীত অভিজ্ঞতায় তাঁরা দেখেছেন যে সেটা করলেও কোনো রহস্যময় কারণে যেন হুবহু মা গাছের মতো তার রং-রূপ হয় না। 

ইউফরবিয়েসি গোত্রের এ গাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ইউফরবিয়া পালচেরেমা (Euphorbia pulcherrima)। আঠারো শতকের বিশের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের জনৈক মন্ত্রী জোয়েল রবার্টস পয়েনসেটের নামানুসারে এ গাছের নাম রাখা হয় পয়েনসেটিয়া। মন্ত্রী হলেও তিনি ছিলেন একজন উদ্ভিদবিদ। পয়েনসেটিয়া গাছের প্রথম লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় ১৮৩৪ সালে ইউরোপীয়দের কাছ থেকে। এ গাছের ডালগুলো খুব নরম। চাপ দিলে মট করে ভেঙে যায় আর সেখান থেকে সাদা দুধের মতো আঠালো কষ ঝরে। গুল্ম প্রকৃতির গাছ, বড়জোর ২ থেকে ৩ মিটার লম্বা হয়। ডালে সবুজ পাতাগুলো এপাশ-ওপাশ করে বিপরীতমুখীভাবে জন্মে। পাতার ওপরের পিঠ মসৃণ হলেও নিচের পিঠ সামান্য রোমশ ও হালকা সবুজ। পাতা উপবৃত্তাকার। ফুল হলুদাভ, ফল গোলাকৃতি ত্রিকোণাকার। ফলের বীজ হয়। বীজ থেকে চারা তৈরি করা যায়। ফুল ও ফল ধারণের সময় ডিসেম্বর থেকে মার্চ। ডিসেম্বর মাস এলেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে পয়েনসেটিয়া বিক্রির হিড়িক পড়ে যায়। এ সময় মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর প্রায় ৭০ মিলিয়ন পয়েনসেটিয়া গাছ বিক্রি হয়।