রাখাইনসহ মিয়ানমারের নানা অংশে সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের চলমান লড়াই বাংলাদেশের নিরাপত্তা এবং বঙ্গোপসাগরে প্রভাব ফেলবে। আর রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির অব্যাহত লড়াইয়ে রোহিঙ্গা সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের জাতীয় ঐকমত্যের সরকার (এনইউজি) এবং আরাকান আর্মিসহ নানা পক্ষের সঙ্গে যেকোনো স্তরে যোগাযোগের বিষয়টি বাংলাদেশের বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
গতকাল বুধবার মিয়ানমারের চলমান সংকট নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা এই অভিমত ব্যক্ত করেন। আলোচনায় অনলাইনে যুক্ত হয়ে মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্যের সরকারের (এনইউজি) প্রতিনিধি কিউ জ বলেন, সামরিক জান্তাকে হটাতে মিয়ানমারের ইতিহাসে এই প্রথম জনগণ এত প্রবলভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। ফলে সেনাশাসককে না হটিয়ে জনগণ থামবে না। আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে চীন নিজের স্বার্থকে সুরক্ষিত রাখতে মিয়ানমারকে নিজের বলয়ে রাখতে চাইছে বলে সংকট আরও জটিল হয়ে পড়েছে।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্নেন্সের (এসআইপিজি) সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ (সিপিএস) গতকাল ‘মিয়ানমারের বর্তমান সংকট এবং প্রতিবেশী অঞ্চলে এর প্রভাব’ শীর্ষক ওই সেমিনারের আয়োজন করে।
মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের তিন বছর পূর্তি সামনে রেখে ঢাকায় এমন একটা সময়ে এই সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে, যখন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির তুমুল লড়াই চলছে।
সেমিনারে অনলাইনে যুক্ত হয়ে এনইউজির প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ও মুখপাত্র কিউ জ বলেন, ‘মিয়ানমারে সহিংসতা প্রতিদিনই বাড়ছে। অর্থনৈতিক সংকট চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে চলমান বসন্ত বিপ্লব সফল হবে, কারণ মিয়ানমারের জনগণ এখন ইতিহাসের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ। তিন বছর আগে মনে করা হয়েছিল, আসিয়ানের অন্যতম শক্তিশালী এই সেনাবাহিনীকে পরাজিত করা যাবে না। এখন প্রমাণ হয়েছে মিয়ানমারের জনগণ নৃশংস এই সেনাবাহিনীকে হটিয়ে দিতে সামর্থ্য রাখে। এই মুহূর্তে আমরা ৩০টির বেশি শহর নিয়ন্ত্রণে নিয়েছি।’
এসআইপিজির জ্যেষ্ঠ ফেলো ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘মিয়ানমারে যা ঘটছে, তাতে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। রাখাইনে ভয়াবহ লড়াই শুরু হয়েছে, যা এখন বাংলাদেশের সীমান্তের কাছে এসে পড়েছে বলে বলা হচ্ছে। এখন রোহিঙ্গারা আবার সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে কি না, এমন আশঙ্কা রয়েছে। রোহিঙ্গারা সীমান্তের কাছে চলে এলে আমাদের সামনে বিকল্প কী? অন্যদিকে আরাকান আর্মি বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালাচ্ছে। সব মিলিয়ে আমরা খুবই নড়বড়ে এক নিরাপত্তা পরিস্থিতির সামনে রয়েছি। ভূরাজনৈতিকভাবে ঝড়ের কেন্দ্রে আছি। ভবিষ্যতে রাখাইনের লড়াই বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও বঙ্গোপসাগরে প্রভাব ফেলবে।’
অনলাইনে যুক্ত হয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও এসআইপিজির অধ্যাপক মো. শহীদুল হক বলেন, মিয়ানমার ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। কারণ, এটিই একমাত্র দেশ, যেটি স্থলপথে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোকে ভৌগোলিকভাবে যুক্ত করে। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতেও ভারতের জাতীয় স্বার্থ অগ্রাধিকার পাবে। চীনের মতো ভারতও মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখছে। মিয়ানমারের সঙ্গে ভারত তাদের সম্পর্ক আরও বাড়াতে চায়।
মালয়েশিয়ার সুলতান জয়নাল আবেদিন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মো. মাহবুবুল হক বলেন, আসিয়ান দেশগুলো মিয়ানমার সংকট নিরসনে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে দ্বিধাবিভক্ত। সুতরাং এই জোটের পক্ষে কোনো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ, আসিয়ান ‘অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা’র নীতি মেনে চলে।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক রেমন্ড কুন সান লাউ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের নিষেধাজ্ঞা মিয়ানমারে সামরিক জান্তার পদক্ষেপকে পরিবর্তন করবে না। এই অঞ্চলে চীনা স্বার্থ সুরক্ষিত করতে চীন মিয়ানমারকে তার বলয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, যা মিয়ানমার সংকটকে আরও জটিল করছে। চীনের বিনিয়োগ সুরক্ষার স্বার্থে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী ব্যবস্থা না নেওয়ায় চীন সামরিক জান্তার ওপর বিরক্ত। তাই চীন নীরবে মিয়ানমারের অনেক জায়গায় বিদ্রোহীদের সমর্থন দিচ্ছে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা।