তিন দিকে ভারতীয় সীমান্ত, একদিকে পদ্মা নদীঘেঁষা গ্রাম চরখিদিরপুর। গ্রামে কোনো মাধ্যমিক স্কুল না থাকায় পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর প্রায় সব ছেলেই পেশায় হতো ‘রাখাল’ আর বাল্যবিবাহ হয়ে যেত মেয়েদের। উচ্চশিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রথম আলো ট্রাস্টের সহযোগিতায় ‘আলোর পাঠশালা’ নামে বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল চরখিদিরপুর গ্রামে। ২০১৮ সালে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিষ্ঠানটির ওপর নির্মিত হয় একটি প্রামাণ্যচিত্র। এখন কেমন চলছে আলোর পাঠশালা?
ঘুম থেকে জাগার আগেই মা কাজে বেরিয়ে যান। মেয়েটির আর কিছু খাওয়া হয় না। নিজের হাতে এক কাপ চা বানিয়ে খেয়ে স্কুলে চলে আসে সে। মা অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। বাবা তাদের ছেড়ে চলে গেছেন। মেয়েটি হীনম্মন্যতায় ভোগে। সহপাঠীদের সঙ্গে মিশতে পারে না। ক্লাসে মন খারাপ করে বসে থাকে। নীরবে কাঁদে। প্রধান শিক্ষক রেজিনা খাতুন শিশুটিকে কাছে টেনে নেন। চোখের পানি মুছে দেন। তাকে বোঝান, এই পাঠশালায় সবাই সমান। সবার একই পোশাক। এখানে কেউ কাউকে ছোট মনে করে না। মেয়েটি দুঃখ ভুলে সহপাঠীদের সঙ্গে খেলতে যায়।
এ গল্প রাজশাহীর ‘আলোর পাঠশালা’র প্রতিদিনের। এই প্রতিষ্ঠানে পড়া সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাচ্ছে। বাল্যবিবাহকে ‘না’ বলে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। আলো ছড়াচ্ছে আলোর পাঠশালা। নদীভাঙনের কারণে চরখিদিরপুর থেকে এই পাঠশালা এখন স্থানান্তর করা হয়েছে রাজশাহী নগরের তালাইমারী এলাকায়।
পাচ্ছে।
বিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু হয়েছিল চরখিদিরপুর গ্রামে। শতভাগ বাল্যবিবাহের সেই গ্রামের তিন দিকে ভারতীয় সীমান্ত। একদিকে পদ্মা নদী। সেখানে প্রায় ১০ হাজার মানুষের বসবাস ছিল। সেখানে রয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তে হলে তাদের ভারতীয় ভূখণ্ডের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেতে হয় অথবা পদ্মা নদী পার হয়ে আসতে হয় রাজশাহী শহরে। দুটোই তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এ জন্য পঞ্চম শ্রেণি পাস করে ছেলেরা হয়ে যায় গরুর রাখাল। আর মেয়েদের বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে।
২০১১ সালের কথা। ওই এলাকার শিক্ষার্থীদের ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠদানের উদ্যোগ নেন এই প্রতিবেদক। সেই উদ্যোগে সাড়া দিয়ে ‘বঞ্চিতিবদল’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠদান শুরু করে। তাদের সহযোগিতা করেন প্রথম আলোর রাজশাহীর বন্ধুসভার বন্ধুরা। এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে রাজশাহীর তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবদুল হান্নান সেখানে একটি আধা পাকা ভবন তৈরি করে দেন। সেখানেই শুরু হয় চরখিদিরপুর নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়।
২০১৫ সাল থেকে বিদ্যালয়টি প্রথম ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে যাত্রা শুরু করে। ট্রাস্টের পক্ষ থেকে পাঁচজন শিক্ষক ও একজন সহায়ক কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা প্রতিদিন রাজশাহী শহর থেকে নৌকায় পদ্মা নদী পার হয়ে বিদ্যালয়ে গিয়ে পাঠদান করেন। বিদ্যালয়ের শতভাগ শিক্ষার্থী জেএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। তাদের মধ্যে একজন পায় জিপিএ-৫।
২০১৬ সালের বন্যায় বিদ্যালয়ের প্রথম ভবনটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তখন চরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নতুন ভবনে স্থানান্তর করা হয়। বিচ্ছিন্ন চরের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার গুরুত্ব উপলব্ধি করে স্থানীয় প্রশাসন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরোনো ভবনটি প্রথম আলো ট্রাস্টের বিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দেয়।
২০২০ সালে চরখিদিরপুর গ্রামের ৯০ শতাংশের বেশি অংশ পদ্মাগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ভেঙে যায় প্রথম আলো ট্রাস্টের আলোর পাঠশালাও। চরের বাসিন্দাদের অনেকেই রাজশাহী নগরের বস্তিতে এসে আশ্রয় নেন। তখন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে পাঠশালাটি বস্তির পাশেই নগরের তালাইমারী এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। চরখিদিরপুর থেকে আসা ও নগরের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য আবার আলোর পাঠশালা একটি আদর্শ বিদ্যানিকেতন হয়ে উঠেছে। সকালে শিক্ষার্থীরা যখন সারবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে শারীরিক কসরত প্রদর্শন করে, এলাকাবাসী মুগ্ধ হয়ে তা দেখেন। বর্তমানে এই পাঠশালায় ১২৩ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশু বিনা বেতনে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে।