ওসিসিতে ভর্তি ভুক্তভোগী নারী ও শিশুর তুলনায় মামলা এক-তৃতীয়াংশ কম। যা হচ্ছে, সেগুলোর বিচারকাজেও জট।
ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের মামলার জট দেখা দিয়েছে। ওসিসিতে ভর্তি ভুক্তভোগীর তুলনায় এমনিতে এক-তৃতীয়াংশ কম মামলা হচ্ছে। আবার মামলা যা হচ্ছে, সেগুলোর রায় ও রায় কার্যকরের হার কম। ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ওসিসির মামলা বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
১৪টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) রয়েছে। এসব সেন্টারে শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন ও দগ্ধ (আগুন, অ্যাসিডসহ দাহ্য পদার্থ)—এই তিন ধরনের সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ ছাড়া দেওয়া হয় ডিএনএ পরীক্ষা, পুলিশ ও আইনি সহায়তা, কাউন্সেলিং এবং পুনর্বাসন সেবা।
এর বাইরে জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬৭টি ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেলে সেবা দেওয়া হয়। তবে সেলে চিকিৎসা, ডিএনএ ও আইনি সহায়তা প্রত্যক্ষভাবে নয়, সমন্বয় করে দেওয়া হয়।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম’–এর আওতায় ওসিসির (সেন্টার ও সেল) কার্যক্রম চলে। ২০০০ সাল থেকে প্রকল্পটি চলছে।
মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১৪টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে সহিংসতার শিকার মোট ৫৬ হাজার নারী ও শিশু ভর্তি হন। এসব ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন এবং অ্যাসিড অপরাধ দমন আইনে ১৭ হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২ হাজার মামলার রায় হয়েছে এবং সাজা কার্যকর হয়েছে মাত্র ২২০টির। মোট মামলায় সাজা কার্যকরের এই হার মাত্র ১ শতাংশ। এ ছাড়া ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৬৭টি সেলে ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৯৩ ভুক্তভোগী সেবা নেন।
এসব ঘটনায় দায়ের মামলার সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে অন্যান্য মামলার মতো ওসিসির মামলার বিচারকাজও দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকে। কিছু মামলা আপসও হয়ে যায়। আর ওসিসিতে সেবা নেওয়া সব ভুক্তভোগী মামলা করেন না। পারিবারিক, সামাজিক নানা কারণে অনেক নারী মামলা করতে আগ্রহী হন না।
ধর্ষণের শিকার হয়ে সবচেয়ে বেশি নারী ও শিশু ওসিসিতে ভর্তি হন। এরপরই রয়েছে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা। গত ২২ বছরে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০ হাজার ৮৮৮ নারী ও শিশু এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ৩৪ হাজার ৬০৯ জন ভর্তি হন। দগ্ধ হয়ে ভর্তি হন ৫২৭ জন।
গত ১৪ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেলের ওসিসিতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার তিন শিশু ও কিশোরীকে ভর্তি পাওয়া যায়। তিনজনই ধর্ষণের শিকার হয়েছে অভিযোগ এনে পরিবার মামলা করেছে। তাদের মধ্যে রাজধানী মুগদার ১৩ বছরের এক কিশোরীর পরিবার মামলায় উল্লেখ করেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক কিশোরের সঙ্গে পরিচয় থেকে মেয়ে প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়। সে প্রেমিকের সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়। গত ১২ জানুয়ারি কিশোরীটিকে ওসিসিতে ভর্তি করা হয়। একই ধরনের ঘটনায় আরেক কিশোরীর পরিবারও ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেছে। তাকে ৮ জানুয়ারি ভর্তি করা হয়। আগের দিন ৭ জানুয়ারি মিরপুরের এক শিশুকে (১১) ভর্তি করা হয়।
গত বছরের ডিসেম্বরের হিসাব থেকে দেখা গেছে, ১৪টি সরকারি মেডিকেলের ওসিসিতে মোট ৪০৯ জন ভর্তি হয়েছিলেন। এর মধ্যে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু ছিল ১৩৩টি। ভর্তি ৪০৯ জন হলেও মামলা হয়েছে ১৬৪টি।
ঢাকা মেডিকেলের ওসিসির সমন্বয়কারী আফরোজা বেগম বলেন, অনেক ক্ষেত্রে মামলা করার পর ওসিসিতে ভর্তি হন ভুক্তভোগীরা। আবার ওসিসি থেকেও অনেকে আইনি সহায়তা নেন। শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে স্বামীর হাতে নির্যাতন, পারিবারিক নির্যাতন ও গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা থাকে।
ওসিসিতে গত ১৪ জানুয়ারি দুই নারীকে পাওয়া যায়, যাঁরা স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে রাজধানীর পল্লবী এলাকার এক নারী স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে ১১ জানুয়ারি ভর্তি হন। ওই নারীর দেড় বছর বয়সী এক ছেলে রয়েছে। একই দিনে ভর্তি হন রাজধানীর আরেক নারী, যাঁর দুই শিশুসন্তান রয়েছে। স্বামী গোপনে বিয়ে করেছেন। এ নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকে স্বামী তাঁকে মারধর করেন।
চিকিৎসক আফরোজা বেগম বলেন, দুই নারীর শরীরেই আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হকের মতে, বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা ও প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে অনেক ভুক্তভোগী মামলা করতে চান না।
দীর্ঘ সময় ধরে মামলার পেছনে ছুটতে তাঁদের ভালো লাগে না। তাই সহিংসতার শিকার নারীদের আইনের আশ্রয় নিতে আগ্রহী করতে বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে। জবাবদিহি শক্তিশালী হলে সহিংসতার ঘটনাও কমে আসবে।