যেসব কালাকানুন স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য অন্তরায়, সেগুলো বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন সংবাদপত্রের সম্পাদকেরা। একই সঙ্গে স্বাধীন গণমাধ্যম কমিশন গঠন, সংবিধান সংস্কারে কমিশন, ব্যাংকিং খাত সংস্কারে কমিশন, সুশাসন প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন পর্যায়ে সংস্কারেরও প্রস্তাব করেছেন তাঁরা।
গতকাল মঙ্গলবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে এসব দাবি ও প্রস্তাব তুলে ধরেছেন সংবাদপত্রের সম্পাদকেরা। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তিনি সত্যিকার অর্থে সক্রিয় (ভাইব্র্যান্ট) গণমাধ্যম চান। সত্যিকার অর্থে তিনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। আর এই সক্রিয় গণমাধ্যমের জন্য যা যা করা প্রয়োজন, তা–ই করবেন। প্রধান উপদেষ্টা সরকার পরিচালনায় ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতেও গণমাধ্যমকে সোচ্চার থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠকের পর সাংবাদিকদের আলাদাভাবে ব্রিফ করেন সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
এ ছাড়া বৈঠকে উপস্থিত সূত্রে আলোচনার বিভিন্ন বিষয় জানা গেছে। বৈঠকে ২০ জন সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন। দুই পক্ষই জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে।
বৈঠকে মাহ্ফুজ আনাম ছাড়াও সম্পাদকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ইত্তেফাক–এর তাসমিমা হোসেন, প্রথম আলোর মতিউর রহমান, দৈনিক আজাদীর এম এ মালেক, আমাদের সময়–এর আবুল মোমেন, দ্য নিউএজ–এর নূরুল কবীর, যুগান্তর–এর সাইফুল আলম, সংবাদ–এর আলতামাশ কবির, কালের কণ্ঠ–এর হাসান হাফিজ, ইনকিলাব–এর এ এম এম বাহাউদ্দীন, করতোয়ার মোজাম্মেল হক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড–এর ইনাম আহমেদ, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস–এর শামসুল হক জাহিদ, প্রতিদিনের বাংলাদেশ–এর মুস্তাফিজ শফি, বণিক বার্তার দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, ঢাকা ট্রিবিউন–এর জাফর সোবহান, কালবেলার সন্তোষ শর্মা, দেশ রূপান্তর–এর মোস্তফা মামুন, পূর্বকোণ–এর ম. রমিজউদ্দিন ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার মাহবুব মোর্শেদ।
ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর সরকারের কর্মকাণ্ডের প্রতি আমরা সম্পূর্ণভাবে একাত্মতা ঘোষণা করেছি। আমরা চাই বাংলাদেশে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হোক। একজন সম্পাদক হিসেবে আমি প্রশ্ন উত্থাপন করেছি যে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যত্রতত্র যে খুনের মামলা হচ্ছে, এটা যেন বন্ধ হয়। এ ব্যাপারে সরকার যেন সুস্পষ্ট একটি ব্যবস্থা নেয়। সাংবাদিকদের যদি কোনো রকম দোষ থাকে, তাঁরা যদি দুর্নীতিতে জড়িত থাকেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আলাদা মামলা হবে, কিন্তু এভাবে যেন না হয়।’
মাহ্ফুজ আনাম, ‘আমরা চাই বাংলাদেশে একটি জাতীয় ঐক্য স্থাপিত হোক। এই সরকারের কাছ থেকে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আশা করছি। সেই সংস্কারের মধ্যে সংবিধান পরিবর্তন, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো—দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশন সংস্কার করে সত্যিকার অর্থে গণমুখী সংস্থা, বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন যেন ভবিষ্যতে সব নির্বাচন সত্যিকার অর্থে জাতির ও ভোটারদের চিন্তার প্রতিফলন ঘটায়, এ রকম একটা সংস্থা চাই। আমরা এ রকম একটি দুর্নীতি দমন কমিশন চাই, তারা যেন স্বাধীনভাবে কাজ করে।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতার সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার কথা বলেছেন সম্পাদকেরা।
গণমাধ্যম নিষ্পেষণের জন্য যত কালাকানুন যেমন সাইবার নিরাপত্তা আইন বা এ ধরনের সব আইন বাতিল করার কথা বলেছেন সম্পাদকেরা। এ বিষয়ে মাহ্ফুজ আনাম বলেন, ‘অন্ততপক্ষে এ মুহূর্তে যেন ঘোষণা দেওয়া হয় যে এই আইনগুলোতে সাংবাদিকদের নিপীড়নের যে ধারাগুলো আছে, এগুলো কার্যকর হবে না এবং এটির সংস্কার সরকার সময় নিয়ে করবে।
সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব প্রসঙ্গে ডেইলি স্টার সম্পাদক বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যদি মনে করেন, এর জন্য একটি বিশেষ কমিটি করে দিয়ে সব ধরনের আইনের পরিবর্তন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, পুলিশ সংস্কার—এগুলো কমিটির মাধ্যমে বা বিভিন্নভাবে হতে পারে।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার অবস্থানের বিষয়ে মাহ্ফুজ আনাম বলেন, ‘ড. ইউনূস আমাদের বলেছেন যে তিনি সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন সাংবাদিকতায় বিশ্বাস করেন এবং আমাদের কাছে ওনার বিশেষ আবেদন হচ্ছে, আমরা যেন আমাদের লেখনীর মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় কাজ করি। এই সরকার পরিচালনার সব ক্ষেত্রে ভুলত্রুটি যেন আমরা ধরিয়ে দিই। এই সরকারের ভুলত্রুটি হলে আমরা যেন নির্দ্বিধায় কাগজে ছাপি এবং এই সরকারকে সাহায্য করি।’
মাহ্ফুজ আনাম বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কত দিন থাকবে, এটা নিয়ে অনেকেই মতামত দিয়েছেন বিভিন্ন সময়। কিন্তু মূল কথা যেটা আসছে, সেটা হলো এই সরকারের এজেন্ডা কী? সেই অনুপাতে সময়। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বলেছে যৌক্তিক সময়, এগুলো তো অস্পষ্ট। প্রধান উপদেষ্টার ইচ্ছা, গণমাধ্যমে এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে তাঁকে একটি ধারণা দেওয়া হোক যে জাতি কী চায়, কত বছর হতে পারে দুই-তিন-পাঁচ বছর? এটা নিয়ে তাঁর নিজস্ব কোনো চিন্তা নেই, তিনি জনতার চিন্তা জানতে চান। সে ব্যাপারে তিনি গণমাধ্যমকে আহ্বান করেছেন, গণমাধ্যম যেন জনগণের কথা লেখে এবং তাঁকে জানানো হয়।
এ বিষয়ে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এই সরকার যেন যৌক্তিক সময় পর্যন্ত থাকে। সম্পাদকদের কাছে প্রধান উপদেষ্টা জানতে চেয়েছিলেন, এই যৌক্তিক সময়টি কত দিন হতে পারে। সম্পাদকেরা বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার কাজই নির্ধারণ করবে কত দিন থাকবেন।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম বলেন, সম্পাদকদের কেউ কেউ দু-তিন বছরের কথা বলেছেন। কেউ কেউ দুই বছরের কথা বলেছেন। আসলে এটি কাজের ওপর নির্ভর করবে। সবাই বলেছেন, সংস্কারগুলো করা উচিত, যাতে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো শক্ত হয়।
অবশ্য বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, উপস্থিত বেশির ভাগ সম্পাদক সরকারের মেয়াদ নিয়ে কিছু বলেননি। মেয়াদের বিষয়টি কেউ কেউ বলেছেন।
সম্পাদকেরা স্বাধীন গণমাধ্যম কমিশন গঠনের কথা বলেছেন বলে জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব। এ ছাড়া উপদেষ্টা পরিষদকে আরও সক্রিয় হয়ে কাজ করার অনুরোধ করেছেন সম্পাদকেরা।
প্রেস সচিব বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দেশের জন্য ও রাষ্ট্র মেরামতের জন্য মস্ত বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। এ সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে।
বৈঠকে উপস্থিত সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, অর্থনৈতিক সংকট আছে; কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি সারা বিশ্বের ইতিবাচক নজর আছে। তারা বাংলাদেশের জন্য কিছু করতে চায়। বড় সহযোগিতার মনোভাব জেগেছে, তারা খুবই উৎসাহী।
সম্পাদকদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনারা পথ দেখাবেন। ভুল করলে বলবেন। জোর গলায় বলবেন। যা করা দরকার সেটাও জোর গলায় বলবেন। সবাই মিলে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। এ জন্য জাতীয় ঐক্য দরকার।’ তিনি বলেন, ‘আমার ইচ্ছার ঘাটতি নেই। সাধ্যমতো কাজ করতে চাই।’
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের সংবাদ ব্রিফিংয়ের পর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে সম্পাদক পরিষদ। এতে উল্লেখ করা হয়, সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘সবাই বলেছেন যে মিনিমাম দুই বছর বা দুই বছরের একটু কম যাতে এ সরকারের মেয়াদ হয়। কিন্তু বেশির ভাগই যৌক্তিক সময় নিয়েও বলতে চাননি। তাঁরা বলেছেন, যে এজেন্ডা বা যে কাজটা তারা করবেন, সেই কাজটাই আসলে ঠিক করবে, তাঁরা কত দিন থাকবেন।’
এ বিষয়ে সম্পাদক পরিষদের বক্তব্য হলো সভায় উপস্থিত সম্পাদকদের বেশির ভাগই সম্পাদক পরিষদের সদস্য। উপস্থিত সম্পাদকদের মধ্যে কেউ কেউ প্রধান উপদেষ্টার জানতে চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তিগত মতামত হিসেবে সরকারের মেয়াদ নিয়ে কথা বলেছেন। মতবিনিময় সভায় উপস্থিত বেশির ভাগ সম্পাদকই সরকারের মেয়াদ নিয়ে কিছু বলেননি। তাঁরা দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, জনমানুষ ও কারখানার নিরাপত্তা এবং এ সরকারের এজেন্ডা বা রূপরেখাকে দ্রুত জনগণের সামনে উপস্থাপনের বিষয়ে বেশি তাগাদা দিয়েছেন।
অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এ বিষয়ে দেওয়া ব্যাখ্যায় বলেছে, বৈঠকে কয়েকজন সম্পাদক পরামর্শ দেন যে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দুই থেকে তিন বছর হতে পারে। তবে বেশির ভাগ সম্পাদকই বলেছেন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় মেয়াদ নির্ধারণ হওয়া উচিত।