এম হুমায়ুন কবীর
এম হুমায়ুন কবীর

আপাতত বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের মাত্রায় বড় পরিবর্তন দেখছি না

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এমন এক সন্ধিক্ষণে এসে অনুষ্ঠিত হলো, যেখানে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস এবং রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ভিন্ন ভিন্ন রূপকল্প নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন। কমলা হ্যারিসের রূপকল্প ছিল নতুন অর্থনীতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে একধরনের অন্তর্ভুক্তিমূলক লক্ষ্য অর্জন। আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের রূপকল্প ছিল, ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বা ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতিকে উপজীব্য করে বহির্বিশ্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে আনার রূপকল্প। যে রূপকল্প অনেক বেশি অন্তর্মুখী, যাতে তাঁর সরকারের আমলের মার্কিন ভাবমূর্তির পুনরুত্থান। ট্রাম্পের সেই ভাবমূর্তিতে রয়েছে শক্তিমত্তার বহিঃপ্রকাশ। ভোটের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ মার্কিন জনগণ অন্তর্ভুক্তিমূলক লক্ষ্যের পরিবর্তে ট্রাম্পের রূপকল্পকেই সমর্থন দিয়েছেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার ফলে যুক্তরাষ্ট্র এখন জলবায়ু পরিবর্তনের নেতৃত্ব থেকে দূরে সরে যাবে। জীবাশ্ম জ্বালানির অর্থনীতি চাঙা করবেন তিনি। অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে উৎপাদনমুখী শিল্পে ফিরিয়ে নিতে চাইবেন। অর্থনীতিতে চীনসহ প্রতিদ্বন্দ্বীদের রুখে দিতে কোটা আরোপের মতো পদক্ষেপ নিয়ে একধরনের সংরক্ষণবাদী অর্থনীতির পথে হাঁটতে পারেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অভ্যন্তরীণভাবে অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ সাময়িকভাবে মোকাবিলা করা গেলেও এমন সংরক্ষণবাদী পদক্ষেপের সুদূরপ্রসারী ফল কিন্তু স্পষ্ট নয়। তিনি বৃহৎ শিল্পপতিদের জন্য শুল্ক ছাড় দেওয়ার কথা বলেছেন। এই পদক্ষেপের ফলে সামাজিক বিভাজনের প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা এখনো অজানা। সব মিলিয়ে তিনি একটি রক্ষণশীল আর্থসামাজিক ব্যবস্থা গড়ার কথা বলছেন।

এখন পর্যন্ত ভোটের ফলাফল থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে সিনেট এবং প্রতিনিধি পরিষদেও রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে চলেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিসরে অধিকাংশ সময় ক্ষমতায় যে ভারসাম্য বজায় থেকেছে, তাতে ছেদ পড়তে পারে। ফলে নিরঙ্কুশ জনসমর্থনের কারণে ক্ষমতার একচ্ছত্র ব্যবহারের ফলে নানা ধরনের প্রশ্ন ওঠার অবকাশ রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ফেরার ফলটা কেমন হবে, তার জবাব খুঁজতে আমাদের সময় লাগবে।

নির্বাচনী প্রচারের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প এক দিনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করার কথা বলেছেন। ইউরোপের শতবর্ষের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ফল এই যুদ্ধ। কাজেই এক দিনেই এই যুদ্ধের সুরাহা করাটা চ্যালেঞ্জের। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে তাঁর অবস্থানটা কেমন হবে, সেটা অনিশ্চিত। ইসরায়েলের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্বের কারণে ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ যে সুরক্ষিত হবে না, তাতে কোনো সংশয় নেই। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে নতুন মার্কিন প্রশাসনের নৈতিক অবস্থান কেমন হবে? ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের মাত্রা কেমন হবে, সেটা এখনো অজানা। গাজা আর লেবাননে চলমান যুদ্ধ অব্যাহত থাকার প্রেক্ষাপটে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতাবস্থা থাকবে না কি শান্তির সুযোগ তৈরি হবে, সেই প্রশ্নগুলো সামনের দিনগুলোতে বড় হয়ে দেখা দেবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার পালাবদল আপাতত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের মাত্রায় বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন দেখছি না। ৫ আগস্ট–পরবর্তী পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে বাইডেন প্রশাসন সহযোগিতার যে আশ্বাস দিয়েছে, ধারণা করি ট্রাম্প প্রশাসন সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে সংস্কারপ্রক্রিয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থন থাকবে। কারণ, বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা থাকুক এবং এই অঞ্চলে কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা যাতে তৈরি না হয়, সে ব্যাপারে মার্কিন প্রশাসনের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। কারণ, এখানে অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে দক্ষিণ এশিয়ায় তা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। তাই ওয়াশিংটনের প্রত্যাশা থাকবে বাংলাদেশে যাতে গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় দৃষ্টিকোণের পাশাপাশি আঞ্চলিক এবং ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। রিপাবলিকানদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশেষ করে ট্রাম্পের যে অবস্থান, সেখানে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে (আইপিএস) চাইবে হোয়াইট হাউস। আবার বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের সাম্প্রতিক গতিপথকে বিবেচনায় নিলে ওয়াশিংটনে ক্ষমতার পালাবদলের ফল এতে কী মাত্রা যোগ করে, সেটা সময় বলে দেবে। হতে পারে দুই নিকট প্রতিবেশীর সম্পর্কের বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে এগোনোর ক্ষেত্রে দুই দেশের হাতে ছেড়ে দিতে পারে মার্কিন প্রশাসন। এটা হলে ভারত নানা ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশকে চাপ দিতে পারে। আবার এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প চাইতে পারেন দক্ষিণ এশিয়ার দুই নিকট প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনা কমুক, সম্পর্ক স্বাভাবিক পথে এগিয়ে চলুক। কারণ, দুই প্রতিবেশীর মধ্যে অস্বস্তি অব্যাহত থাকলে তাতে মাঝখানে চীনের প্রবেশের সুযোগ করে দেবে। ফলে চীনের এই ভূমিকা থামাতে সক্রিয় থাকতে পারে ট্রাম্প প্রশাসন।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং প্রেসিডেন্ট, বিইআই।