জমি অধিগ্রহণের সময় শতকোটি টাকা বাড়তি নিতে প্রকল্প পাসের আগেই জমি ক্রয় এবং কৌশলে দলিলমূল্য বৃদ্ধি।
মানিকগঞ্জে সরকারি ওষুধ কারখানার জন্য যে সাড়ে ৩১ একর জমি প্রস্তাব করা হয়েছে, সেখানকার ১১ একর ১৪ শতক জমি কেনেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের মেয়ে সিনথিয়া মালেক। তিনি এ জমি ভরাট করে ভিটি শ্রেণিতে পরিবর্তন করেন। মাস সাতেক পর ওষুধ কারখানা স্থাপনের প্রকল্প পাস হয়। তার ২০ দিন আগে কেনা মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ দেখিয়ে এসব জমি স্বামী আলতাফ আকমলকে দান করেন সিনথিয়া। এখন সরকার এ জমি অধিগ্রহণ করতে গেলে সর্বশেষ মূল্যের তিন গুণ বেশি টাকা দিতে হবে। অর্থাৎ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মেয়ে সাড়ে ৭ কোটি টাকায় যে জমি কিনেছেন, সেটা সরকার অধিগ্রহণ করলে ৪০ কোটি টাকা পাবেন তিনি বা তাঁর স্বামী।
প্রস্তাবিত ওই স্থানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বিডি সান লিমিটেডের নামে কেনা হয় ৬ একর ৩৯ শতক জমি। মন্ত্রীর ছেলে রাহাত মালেকের মালিকানাধীন রাহাত রিয়েল এস্টেটের নামে কেনা হয় ৩ একর ১২ শতক জমি। অর্থাৎ সাড়ে ৩১ একর জমির মধ্যে ২০ একর ৬৫ শতাংশ জমি মন্ত্রী, তাঁর ছেলে ও মেয়ে কিনেছেন।
এরপর শ্রেণি পরিবর্তন করে এক লাফে জমির মূল্য (মৌজা দর) পাঁচ গুণ বৃদ্ধি করা হয়। তারপর তিনজনই এসব জমি বর্ধিত দরে (মৌজা রেটে) ঘনিষ্ঠজনদের নামে দান বা বিক্রি করেছেন। এর বাইরে মন্ত্রীর ফুফাতো ভাই শামীম মিয়া কিনেছেন আরও ৫ একর ৫৪ শতক জমি।
প্রকল্পের ধারণার শুরু থেকেই এটাকে সম্পদ বিকাশের উপায় হিসেবে দেখেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা।ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি
প্রকল্প পাসের পর ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরুর পর্যায়ে জেলা ভূমি ব্যবস্থাপনা কমিটির পর্যালোচনায় প্রস্তাবিত জমি নিয়ে এমন কারসাজির বিষয়টি উঠে আসে। এমন পরিস্থিতিতে এই জমিতে প্রকল্প করতে গেলে ভূমি অধিগ্রহণে সরকারের প্রায় ১০০ কোটি টাকা বেশি ব্যয় হবে। এর পরিবর্তে পাশের কোনো মৌজায় প্রকল্প করলে সরকারের এই টাকা সাশ্রয় হবে। বিষয়টি জানিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেন মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক।
এই চিঠি দেওয়ার পরপর বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তুলে জেলা প্রশাসকের অপসারণ দাবিতে আন্দোলনে নামেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে দেন মন্ত্রীর ফুফাতো ভাই মো. ইসরাফিল হোসেন, যিনি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি শামীম মিয়ার বড় ভাই।
প্রকল্পটি হচ্ছে সরকারি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) মানিকগঞ্জে কারখানা স্থাপন। ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) প্রকল্পটি পাস হয়। এতে মোট ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে জমি অধিগ্রহণের জন্য ব্যয় ধরা হয় ১১৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। সরকারি অর্থায়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৭ সালের মার্চ পর্যন্ত। প্রকল্পের জন্য মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার জাগীর ইউনিয়নের মেঘশিমুল এলাকায় সাড়ে ৩১ একর জমি প্রস্তাব করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, প্রকল্প কোথায় হবে, সেটা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রকল্প পাসের সময় প্রস্তাব করে থাকে। তাই প্রকল্প পাসের আগেই ওই এলাকার জমি কিনে নিয়ে শ্রেণি পরিবর্তন এবং তারপর সে জমি অন্যের নামে হস্তান্তর ও মূল্যবৃদ্ধির এই কার্যক্রমকে ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি কোনো প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হলে জমির মালিক ক্ষতিপূরণ হিসেবে মৌজা দরের তিন গুণ দাম পান। অভিযোগ উঠেছে, অধিগ্রহণ বাবদ সরকারি কোষাগার থেকে ১০০ কোটি টাকা বের করে নিতে কারসাজির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি তুলে ধরে গত ফেব্রুয়ারিতে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আবদুল লতিফ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক প্রথম আলোকে বলেন, প্রস্তাবিত স্থানে জমি অধিগ্রহণ করলে সরকারের ১০০ কোটি টাকা ক্ষতি হবে। ভূমি ব্যবস্থাপনা কমিটি মেঘশিমুল মৌজায় প্রস্তাবিত জমির সম্ভাব্যতা যাচাই করার পরই বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং সরকারকে অবহিত করে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি যা বলার চিঠিতে উল্লেখ করেছি। এর বাইরে আমার কোনো বক্তব্য নেই।’
মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসন থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, সরকারি ওষুধ কারখানা স্থাপনের জন্য মানিকগঞ্জের মেঘশিমুল মৌজায় সাড়ে ৩১ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব পাওয়া গেছে। গত ডিসেম্বরে জমি অধিগ্রহণের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়।
প্রস্তাবিত জমির শ্রেণি নাল (কৃষি) হলেও সম্প্রতি বালু ভরাট করে ভিটি (বাড়ি) শ্রেণি করা হয়েছে। একই সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে মহাপরিদর্শক নিবন্ধনের একটি স্মারকে এবং মানিকগঞ্জ জেলা নিবন্ধকের একটি স্মারকে ভিটি (বাড়ি) শ্রেণির প্রতি শতাংশ জমির মূল্য ২৫ হাজার থেকে এক লাফে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা করা হয়। অর্থাৎ ভিটি (বাড়ি) শ্রেণির জমির মূল্য বাড়ানো হয় প্রায় পাঁচ গুণ। তবে আশপাশের কোনো মৌজায় জমির মূল্য বাড়ানো হয়নি।
মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, মেঘশিমুল মৌজায় ভিটি শ্রেণির জমির সরকারি মূল্য বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী আইন মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার (আধা সরকারি সুপারিশপত্র) দেন। এরপর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে হঠাৎ করেই ওই মৌজার ভিটি শ্রেণির দাম পাঁচ গুণ বেড়ে যায়; যা অস্বাভাবিক।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভিটি শ্রেণির মূল্য পাঁচ গুণ বাড়ানোর দুই মাস পর মন্ত্রী ও তাঁর ছেলে যখন সাড়ে ৯ একর জমি উচ্চ মূল্য দেখিয়ে বিক্রি দেখিয়েছেন, ঠিক সেই সময়েই সেখানে নাল শ্রেণির জমি কেনা শুরু করেন মন্ত্রীর মেয়ে সিনথিয়া মালেক।
এটা ‘সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়’ বলে মন্ত্রণালয়ে লেখা মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসকের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। চিঠিতে বলা হয়, যেখানে মেঘশিমুল মৌজায় ভিটি (বাড়ি) শ্রেণির জমির মূল্য প্রতি শতাংশ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেখানে পাশাপাশি আরও চারটি মৌজায় একই শ্রেণির জমির দাম ১৬ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ আশপাশের মৌজা থেকে মেঘশিমুল মৌজায় ভিটি (বাড়ি) শ্রেণির জমির দাম ৪ থেকে ৮ গুণ বেশি।
সরকারের আর্থিক ক্ষতি এড়াতে পার্শ্ববর্তী কোনো মৌজায় এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে জেলা প্রশাসন। মেঘশিমুল মৌজার উত্তরে ঢাকুলিতে অকৃষি (ভিটি/বাড়ি) শ্রেণির জমির মৌজামূল্য ১৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ এই মৌজার ভিটি শ্রেণির জমিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করলে জমি অধিগ্রহণে সরকারের খরচ হবে সাড়ে ১৬ কোটি টাকা। এতে সরকারের প্রায় ১০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। একইভাবে মেঘশিমুল মৌজার দক্ষিণে কুকুরিয়া, পশ্চিমে ধারিচোরা ও পূর্বে জাগীর মৌজায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে সরকারের ৬১ কোটি থেকে ১০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আবদুল লতিফ প্রথম আলোকে বলেন, বিপুল পরিমাণ টাকা সরকারি কোষাগার থেকে অপচয় হবে। চিঠিতে সেটিই জানানো হয়েছে।
অবশ্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, মেঘশিমুল মৌজা এবং আশপাশের এলাকার জমির সরকারি মূল্য কম হলেও বাস্তবে দাম অনেক বেশি। প্রকল্পটি মেঘশিমুল মৌজায় না করে আশপাশের কোনো মৌজায় করলে সরকারকে আরও বেশি অর্থ খরচ করতে হবে।
বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ঢাকার বারিধারার বাসায় এই প্রতিবেদকের কথা হয় গত ৫ জুন। এ সময় মন্ত্রী বলেন, মানিকগঞ্জের বর্তমান জেলা প্রশাসকের সঙ্গে তাঁর একটা দূরত্ব আছে। জেলা প্রশাসক ইচ্ছে করে ইডিসিএলের প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছেন না। ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিলম্ব করছেন। জমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম শুরু না করে হঠাৎ করে চিঠি দিয়ে প্রকল্পটি বন্ধ করার চেষ্টা করছেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে এরই মধ্যে ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে। অর্থাৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে এখন ২০০ কোটি টাকা বেশি লাগবে।
প্রস্তাবিত স্থানের জমি কেনাবেচার সর্বশেষ নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক তাঁর মালিকানাধীন বিডি সান পাওয়ার লিমিটেডের নামে ৬ একর ৩৯ শতক জমি কেনেন। দলিল অনুযায়ী, প্রতি শতক ৫৫ হাজার থেকে ৬৭ হাজার ৬১৯ টাকা দরে কিনেছেন। সেই জমি তিনি প্রতি শতক ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দরে ২০২১ সালের মার্চে বিক্রি করেন।
জমি বিক্রির আগে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে মেঘশিমুল মৌজার ভিটি শ্রেণির জমির মূল্য পাঁচ গুণ বাড়ানো হয়। এর দুই মাস পর ৪ একর ৭৮ শতক জমি এনডিই স্টিল স্ট্রাকচার্স লিমিটেডের নামে হস্তান্তর করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
মন্ত্রীর কেনা বাকি ১ একর ৬১ শতক জমি আফছার উদ্দিন সরকারের নামে এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আফছার উদ্দিনের বাড়ি মন্ত্রীর গ্রামে। এলাকায় মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তিনি গড়পাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
মন্ত্রীর ছেলের মালিকানাধীন রাহাত রিয়েল এস্টেটের নামে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কেনা হয় ৩ একর ১২ শতক জমি। শতক ৬৭ থেকে ৬৮ হাজার টাকায় কেনা সেসব জমি ২০২১ সালের মার্চে এনডিই স্টিল স্ট্রাকচার্স লিমিটেডের কাছে বিক্রি করা হয়। বিক্রয় মূল্য দেখানো হয় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।
২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক তাঁর মালিকানাধীন বিডি সান পাওয়ার লিমিটেডের নামে ৬ একর ৩৯ শতক জমি কেনেন। দলিল অনুযায়ী, প্রতি শতক ৫৫ হাজার থেকে ৬৭ হাজার ৬১৯ টাকা দরে কিনেছেন। সেই জমি তিনি প্রতি শতক ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দরে ২০২১ সালের মার্চে বিক্রি করেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ও তাঁর ছেলের প্রতিষ্ঠান জমি কিনেছে অনেক আগে। তখন সেখানে সরকারি প্রকল্প করার কোনো বিষয় ছিল না। এসব জমি তাঁরা বিক্রি করে দিয়েছেন। এই মৌজায় (মেঘশিমুল) নিচু জমি ও ভরাট জমির মূল্যের মধ্যে অসামঞ্জস্য ছিল। সে জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে তিনি সেটি সমন্বয় করতে চিঠি দেন। তারা সেটি সমন্বয় করে দাম বাড়ায়। প্রস্তাবিত স্থানে তাঁর মেয়ের নামে কোনো জমি নেই। তবে মেয়ের স্বামীর নামে জমি আছে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভিটি শ্রেণির মূল্য পাঁচ গুণ বাড়ানোর দুই মাস পর মন্ত্রী ও তাঁর ছেলে যখন সাড়ে ৯ একর জমি উচ্চ মূল্য দেখিয়ে বিক্রি দেখিয়েছেন, ঠিক সেই সময়েই সেখানে নাল শ্রেণির জমি কেনা শুরু করেন মন্ত্রীর মেয়ে সিনথিয়া মালেক। জমি কেনাবেচার নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সিনথিয়া মালেক ১১ একর ১৪ শতক জমি কিনেছিলেন ২০২১ সালের ২৯ মার্চ থেকে ২৫ আগস্টের মধ্যে। এরপর বালু ভরাট করে সেই জমি ভিটি (বাড়ি) শ্রেণিতে রূপান্তর করেন। ইডিসিএলের প্রকল্পটি একনেকে পাস হওয়ার ২০ দিন আগে (১৬ মার্চ ২০২২) ওই জমি স্বামী আজমল আকমলকে হেবা দলিলের মাধ্যমে দান করেন তিনি। দলিলে প্রতি শতাংশ জমির মূল্য দেখানো হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।
মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পরিবারের সদস্যদের জমি ক্রয় এবং সেটি প্রকল্প পাস হওয়ার আগেই অন্যদের কাছে হস্তান্তর কৌশলের অংশ। কারণ, অধিগ্রহণের সময় পুরো জমি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকলে সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এ জন্য মৌজা দর বাড়ার পর এসব জমি ঘনিষ্ঠজনদের কাছে হস্তান্তর করে রাখেন।
মন্ত্রী ও তাঁর ছেলে থেকে জমি ক্রয়ের দলিলে ক্রেতা বা গ্রহীতার স্থলে এনডিই স্টিল স্ট্রাকচার্স লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান রিজওয়ান মুস্তাফিজের সই রয়েছে।
গতকাল ঢাকার গুলশানে রিজওয়ান মুস্তাফিজের কার্যালয়ে গেলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মানিকগঞ্জে কোনো জমি কেনার বিষয়ে তাঁর কিছু জানা নেই।
তাঁর সইযুক্ত দলিলের অনুলিপি দেখানোর পর রিজওয়ান মুস্তাফিজ বলেন, ‘এটা ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটারে (বড় হাতের অক্ষরে) লেখা আমার নাম। আমি কখনো ক্যাপিটাল লেটারে স্বাক্ষর করি না।’ তাহলে দলিলে গ্রহীতা হিসেবে কীভাবে আপনার নাম এল—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে আমি কিছুই জানি না, আমার বড় ভাই ইমরান মুস্তাফিজ বলতে পারবেন।’
এরপর বনানীতে এনডিই স্টিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরান মুস্তাফিজের কার্যালয়ে গেলে তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এসে এই প্রতিবেদকের পরিচয়পত্র দেখেন। তারপর ‘স্যার ব্যস্ত আছেন, একটু বসেন, দেখা করবেন’ বলে এই প্রতিবেদককে অপেক্ষা করতে বলেন। এক ঘণ্টা বসিয়ে রেখে আর দেখা দেননি।
প্রকল্পের প্রস্তাবিত স্থানে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ফুফাতো ভাই শামীম মিয়া কিনেছেন ৫ একর ৫৪ শতক জমি। দলিল অনুযায়ী ক্রয়মূল্য ৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এই জমি অধিগ্রহণ করা হলে তিনি ক্ষতিপূরণ পাবেন ১৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
শামীম মিয়া জাগীর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের ভাই। শামীম মিয়া প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, জমি অধিগ্রহণ করা হবে, এমনটা ভেবে তিনি জমি কেনেননি। এখানে কোনো কারসাজি হয়নি।
সরকারি প্রকল্পের সম্ভাব্য এলাকায় জমি কিনে, কারসাজি করে দলিলমূল্য বৃদ্ধি করে অধিগ্রহণের সময় বেশি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ এর আগেও উঠেছে। চাঁদপুরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের আগেই সেখানকার সাড়ে ৬২ একর জমি মৌজা দরের চেয়ে ২০ গুণ বেশি দাম দেখিয়ে দলিল করে নেয় একটি চক্র।
নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শামীম মিয়া ছাড়া মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আরও দুজন আওয়ামী লীগ নেতার দুই একরের বেশি জমি রয়েছে প্রস্তাবিত স্থানে। তাঁদের একজন গড়াপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আফছার উদ্দিন সরকার ১ একর ৬১ শতকের মালিক। আর কৃষ্ণপুর ইউপি চেয়ারম্যান বিপ্লব হোসেন কিনেছেন ৬০ শতক জমি। এ ছাড়া শাহজাদা রহমান নামে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি কিনেছেন প্রায় এক একর জমি।
সরকারি প্রকল্পের সম্ভাব্য এলাকায় জমি কিনে, কারসাজি করে দলিলমূল্য বৃদ্ধি করে অধিগ্রহণের সময় বেশি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ এর আগেও উঠেছে। চাঁদপুরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের আগেই সেখানকার সাড়ে ৬২ একর জমি মৌজা দরের চেয়ে ২০ গুণ বেশি দাম দেখিয়ে দলিল করে নেয় একটি চক্র। সরকারের ৩৫৯ কোটি টাকা বাড়তি নেওয়ার ওই কারসাজিতে যেসব ব্যক্তির নাম এসেছিল, তাঁরাও একজন মন্ত্রীর নিকটাত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। এ নিয়ে গত বছরের ২৭ জানুয়ারি প্রথম আলোতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। প্রায় একই ধরনের কৌশল মানিকগঞ্জে দেখা যাচ্ছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের ধারণার শুরু থেকেই এটাকে নিজেদের সম্পদ বিকাশের উপায় হিসেবে দেখেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। এখানে ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় অর্থের ব্যাপক অপচয়ের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসন এই প্রতারণার বিষয়টি চিহ্নিত করেছে। সরকারের উচিত হবে জেলা প্রশাসনকে সুরক্ষা দেওয়া, যেন তারা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে না পড়ে। সরকার অর্থের অপচয় ও দুর্নীতি ঠেকাতে যৌক্তিকভাবে পর্যালোচনা করে স্থান নির্বাচন করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার পরামর্শ দেন তিনি।