বাংলা জনপদের মানুষের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ১৯৭১—একটি দীর্ঘ স্বাধিকার আন্দোলন, এর পরিপ্রেক্ষিতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ এবং বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জেনোসাইডের শিকার হয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হওয়া। এ জনপদের মানুষের নিজস্ব স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা যেমন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অর্জন, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন আত্মপরিচয়ের অধিকারপ্রাপ্তি। স্বাধিকার আন্দোলনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা এই আত্মপরিচয় মুছে ফেলার জন্যই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অপারেশন সার্চলাইটের নামে জেনোসাইড শুরু করেছিল। বাংলার মানুষ সেই জেনোসাইড প্রতিরোধ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি নিজস্ব আত্মপরিচয়কেও সুনিশ্চিত করেছে।
মুক্তিযুদ্ধ তাই কেবল ৫০ বছর আগে ঘটে যাওয়া ইতিহাসের একটি চিহ্নমাত্র নয়, বরং বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাংলার মানুষের আত্মপরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দু। এই আত্মপরিচয় কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের নৃতাত্ত্বিক, ভাষা ও সংস্কৃতি বা ধর্মভিত্তিক নয়; বরং বাংলা ভূখণ্ডের সব মানুষের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা রয়েছে এর সঙ্গে জড়িয়ে। কেবল রাজনৈতিক রাষ্ট্র নয়, একটি সাম্য ও মর্যাদাভিত্তিক মানবিক সমাজ গঠনের প্রত্যয়ও ছিল মুক্তিযুদ্ধের। বাংলাদেশ রাষ্ট্র, বাংলার মানুষের পরিচয় এবং সাম্য ও মর্যাদাভিত্তিক মানবিক সমাজ গঠনের প্রত্যয় যত দিন টিকে থাকবে, তত দিন মুক্তিযুদ্ধ কেবল প্রাসঙ্গিকই নয়, জরুরিও বটে।
১৯৭১ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সামরিক ও রাজনৈতিক গৌরবগাথা নিয়ে যতটা আলাপ আছে, নির্যাতন ও নৃশংসতার স্মৃতি সংরক্ষণে ততটাই নির্লিপ্ততা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি এখানে পূর্ণমাত্রায় একটি জেনোসাইডও সংঘটিত হয়েছিল। জেনোসাইড একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ এবং একটি জনগোষ্ঠীর পরিচয় নিশ্চিহ্ন করে ফেলার উদ্দেশ্যে জেনোসাইড ঘটানো হয়। আমাদের বুদ্ধিজীবিতা ও একাডেমিয়াতেও জেনোসাইডকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। জেনোসাইডকে স্রেফ ‘গণহত্যা’ বলে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কত মানুষ হত্যা করেছে, সেটিকে মুখ্য তর্কে পরিণত করা হয়েছে। অথচ গণহত্যা হচ্ছে জেনোসাইডের অনেকগুলো অপরাধের একটি। জেনোসাইডে পরিচয় নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে গণহত্যা, ধর্ষণ, উদ্বাস্তুকরণ, সম্পদ ও সংস্কৃতি ধ্বংস, বুদ্ধিজীবী নিধন, জোর করে ধর্মান্তরকরণের মতো বহু অপরাধ ঘটানো হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রতিটি অপরাধই ঘটিয়েছে এখানে মুক্তিযুদ্ধকালে। সংখ্যা নয় বরং একটি জনগোষ্ঠীর পরিচয় নিশ্চিহ্ন করার অভিপ্রায় হচ্ছে মূল অপরাধ। আমরা নিজেরা জেনোসাইডের শিকার হয়েও মূল অপরাধকেই চিহ্নিত করতে দ্বিধা করছি।
বিংশ শতাব্দীতে যত জেনোসাইড ঘটেছে, সেগুলো প্রমাণের ক্ষেত্রে ভিকটিম ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ একটি জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচ্য হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হলোকাস্টের শিকার মানুষদের সাক্ষ্য সংগ্রহের কাজ এখনো চলমান। ১৯৭১ সালের জেনোসাইডের ক্ষেত্রে জরুরি এই বিষয় সবচেয়ে উপেক্ষিত।
২০১৭ সাল থেকে এই লক্ষ্যে আমরা একটি উদ্যোগ শুরু করি। ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও জেনোসাইডের শিকার ও সাক্ষীদের অনেকে এখনো বেঁচে আছেন। আমরা তাঁদের কাছে যাচ্ছি, তাঁদের সাক্ষ্য ভিডিও করছি এবং ইংরেজি সাবটাইটেলসহ ডিজিটালি সংরক্ষণ করছি। এর উদ্দেশ্য হলো, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকোনো মানুষ যেন জানতে পারে এই জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছিল। কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা ছাড়া কেবলই কয়েকজন ব্যক্তিগত বন্ধুর সহায়তা নিয়ে এর কাজটি এগিয়ে নিয়ে চলেছি।
মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে নতুন করে জানা হয়েছে। নগরে বসে আমরা যেমন ভাবি, মুক্তিযুদ্ধ একটি অতীত হয়ে যাওয়া ঘটনা, আসলে তা নয়। প্রান্তিক পর্যায়ে এখনো সমাজ–রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক মুক্তিযুদ্ধ এবং এর পরম্পরা। বহু পরিবার সে সময় নিঃস্ব হয়ে গেছে, আর এখনো তার জের টানতে হচ্ছে। যারা লুটেরা ছিল, মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছরের মধ্যে তারা আরও ক্ষমতাশালী হয়ে সমাজে ফিরে এসেছে। এই বিভক্তিগুলো এখনো বাস্তবতা।
ভবিষ্যতের দিকে অগ্রযাত্রা কখনোই অতীতকে অস্বীকার করে নয়। এগিয়ে যাওয়ার জন্য পরিচয়ের আত্মবিশ্বাস গুরুত্বপূর্ণ। আত্মপরিচয় গড়ে ওঠে স্মৃতি থেকেই। স্মৃতিশূন্য জনগোষ্ঠী সহজেই দখলদারত্বের শিকার হয়। মুক্তিযুদ্ধকে অতীত বিষয় হিসেবে প্রচার করে স্মৃতি ভুলিয়ে দেওয়ার একটা প্রবল রাজনীতিও তাই বিদ্যমান রয়েছে।
মিলান কুন্ডেরার একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। তিনি বলেছিলেন, ‘ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই আসলে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতিরই লড়াই।’
মুক্তিযুদ্ধ তাই ভোলা যাবে না। ভোলা যাবে না মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যয় এবং জেনোসাইডের নৃশংসতা।
হাসান মোরশেদ: www.1971archive.org –এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান গবেষক।