বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার থেকে বই নিচ্ছেন পাঠকেরা
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার থেকে বই নিচ্ছেন পাঠকেরা

প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়লে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের ৬ লাখ বইয়ের কী হবে

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও গণগ্রন্থাগার পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে এ বছরের ডিসেম্বরে। প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন এ প্রকল্পের মেয়াদ ইতিমধ্যে দুই দফা বাড়ানো হয়েছে। নতুন করে বাড়ানোর সম্ভাবনা কম। প্রকল্পটির আওতায় ৬ লাখের বেশি বই আছে। প্রশ্ন উঠেছে, প্রকল্প শেষে বইগুলোর কী হবে? ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের গাড়িগুলো কী কাজে লাগবে?

দেশজুড়ে ‘আলোকিত মানুষ চাই’ প্রতিপাদ্য নিয়ে ঘুরে ঘুরে পাঠকের হাতে বই পৌঁছে দিতে ও পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি করতে এ কর্মসূচি পরিচালিত হয়ে আসছে। এখন মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে অনিশ্চয়তার মুখে আশঙ্কা করা হচ্ছে, প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে গেলে বিপুলসংখ্যক বই নষ্ট হবে। ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের গাড়িগুলোও অলস বসে থাকবে। সেই সঙ্গে পাঠক হারানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার কর্মসূচি শুরু হয় ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের নিজস্ব উদ্যোগে। পরে প্রায় দুই দশক কর্মসূচির আওতায় ৪৬টি গাড়ি (ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার) দেশের আনাচকানাচে গিয়ে পাঠকদের হাতে বই তুলে দিয়েছে। একপর্যায়ে কেন্দ্রের একার পক্ষে প্রকল্পটি চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। ২০১৭ সালে এসে কর্মসূচির পরিধি কমানো হয়।

ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারে থাকা ৬ লাখের বেশি বই সংরক্ষণ করাটা বেশ ব্যয়বহুল। এ ছাড়া সময়মতো বই হাতে না পেলে পাঠক হতাশ হয়ে পাঠবিমুখ হয়ে যেতে পারে।
কামাল হোসাইন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক (বাস্তবায়ন)।

পরের বছর (২০১৮) ডিসেম্বরে কর্মসূচিতে যুক্ত হয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন গণগ্রন্থাগার। যৌথভাবে প্রকল্পটি এগিয়ে নেওয়া হয়। যুক্ত করা হয় আরও ৩০টি গাড়ি। এখন ৭৬টি গাড়ি নিয়ে কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। প্রথম দফায় ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় দফায় ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মসূচির মেয়াদ বাড়ানো হয়।

ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের দৃষ্টিনন্দন গাড়িগুলো সাতটি আলাদা মাপের। আকারভেদে এসব গাড়িতে ৪ হাজার, ৬ হাজার, ৮ হাজার, ১১ হাজার ও ১৭ হাজার বই আছে। প্রতিটি গাড়ি সপ্তাহজুড়ে শহর ও গ্রামভেদে ৪০টি এলাকায় যায়। একেকটি এলাকায় ৩০ মিনিট থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত অবস্থান করে। পাঠকদের মধ্যে বই বিতরণ করে।

প্রতি সপ্তাহে কোন গাড়ি কোন এলাকায়, কয়টায় গিয়ে বই দেওয়া–নেওয়া করবে, সেটি আগে থেকে নির্ধারণ করা থাকে। জেলা ও উপজেলা পর্যন্ত এসব গাড়ি যায়। দেশজুড়ে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারে নথিভুক্ত সাড়ে ৫ লাখের বেশি পাঠক আছেন। এর মধ্যে আড়াই লাখের বেশি পাঠক তৈরি হয়েছে ২০১৯ সালের পর, অর্থাৎ গণগ্রন্থাগারের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ শুরুর পরে।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক (বাস্তবায়ন) কামাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আলোকিত মানুষ চাই’ ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের পাঠকের মধ্যে ৮০ শতাংশই শিশু ও নারী। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ পাঠক প্রথম কোনো পাঠাগারের সদস্য হয়ে বই পড়তে শুরু করেছেন।

ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের সঙ্গে দেশের আনাচকানাচে ঘুরে পাঠকদের হাতে বই পৌঁছে দেওয়া ও পাঠাভ্যাস তৈরির কাজ করেন শেখ ফাতিমা পাপিয়া। তিনি জানান, দেড় শ টাকা দিয়ে কার্ড করলে একজন পাঠক দুই শ টাকা দামের বই প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পড়তে পারেন। আর দুই শ টাকার কার্ডের সদস্য হলে পাঁচ শ টাকা দামের বই নিতে পারেন। দুটি কার্ডের মেয়াদ পাঁচ বছর করে।

তৃতীয় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো না গেলে কিংবা ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার কর্মসূচি অন্য কোনো প্রকল্পের আওতায় চালু করা না গেলে পাঠক হারানোর আশঙ্কা করছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। কামাল হোসাইন বলেন, ‘সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের আওতায় যুক্ত হওয়ার আগে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাভাবে প্রকল্পটি ধুঁকে ধুঁকে চলেছে। ওই সময় কর্মীদের বেতনও কাটছাঁট করতে হয়েছিল।’

ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার নিয়ে দেশজুড়ে বেশ ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। কিন্তু এবার মেয়াদ শেষ হলে কী হবে, তা এখনো ঠিক করা হয়নি।
নাফরিজা শ্যামা, প্রকল্প পরিচালক ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এই কর্মকর্তা বলেন, এ বছর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। সরকারি প্রকল্পের মেয়াদ তৃতীয় দফা বাড়ানোর উদাহরণ কম। এখনই সিদ্ধান্ত না নিলে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের গাড়িগুলো অর্থের অভাবে বসে থাকবে। পাঠকের কাছে বই পৌঁছাতে পারবে না।

ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারে থাকা ৬ লাখের বেশি বই সংরক্ষণ করাটা বেশ ব্যয়বহুল। এ ছাড়া সময়মতো বই হাতে না পেলে পাঠক হতাশ হয়ে পাঠবিমুখ হয়ে যেতে পারেন, এমন আশঙ্কার কথা জানালেন কামাল হোসাইন।

মেয়াদ ফুরালে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের ভবিষ্যৎ কী—এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যোগাযোগ করা হয় প্রকল্পের পরিচালক ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাফরিজা শ্যামার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার নিয়ে দেশজুড়ে বেশ ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। কিন্তু এবার মেয়াদ শেষ হলে কী হবে, তা এখনো ঠিক করা হয়নি।’

নাফরিজা শ্যামা আরও বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করেছি। প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ বিভাগ (আইএমইডি) আগে প্রতিবেদন জমা দেবে। এ প্রতিবেদন পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’