দরিদ্র মানুষের চাল ও টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা

একনজরে চর রাজিবপুর

# দেশে মোট উপজেলা ও থানা ৫৭৭টি, সবচেয়ে দরিদ্র উপজেলা কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর
# উত্তরে রৌমারী, পূর্বে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে জামালপুর ও গাইবান্ধা, পশ্চিমে গাইবান্ধা ও চিলমারী উপজেলা।
# আয়তন: ১১১.০৩ বর্গকিলোমিটার
# উপজেলার জনসংখ্যা ৮৪ হাজার, দারিদ্র্যের হার ৭৯.৮ শতাংশ
# জেলা সদর থেকে ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন, অনেকটা দ্বীপের মতো
# কুড়িগ্রাম শহরে আসতে নদী পার হতে হয়
# নদীভাঙন সবচেয়ে বড় সমস্যা, এ কারণে ভিটেমাটি ছাড়া হয় মানুষ
# এলাকায় কাজের অভাবে টাঙ্গাইল, ঢাকায় দিনমজুরের কাজ করেন
# সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি পর্যাপ্ত নয়
# দুর্নীতির কারণে সরকারের সহায়তাও সবাই পান না

নদের ভাঙনের শিকার শাহ আলমের নামে পুনর্বাসন সহায়তার ৫০ হাজার টাকা ওঠানো হয়েছে। কিন্তু শাহ আলম বলছেন, তিনি টাকা পাননি। ২৭ ফেব্রুয়ারি চর রাজিবপুরের শংকর মাধবপুর গ্রামে।

শংকর মাধবপুরের শাহ আলম দুই বছর আগে নদীভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। তিনি পাশের বিলপাড়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। পেশায় দিনমজুর শাহ আলমের একটি চোখ গত বছর নষ্ট হয়ে যায়। ‘নদীভাঙনকবলিত এলাকার জনসাধারণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পুনর্বাসন সহায়তা’ তালিকায় তাঁর নাম আছে। তাঁর নামে ৫০ হাজার টাকা তোলাও হয়েছে। তবে সেই টাকা তিনি পাননি।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বাড়িতে বসে শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বপ্নেও দেখি নাই। টাকা পামু কোত্থ্যাইকা।’

ইজ্জত আলীর নামে পুনর্বাসন সহায়তার ৫০ হাজার টাকা ওঠানো হয়েছে। তবে ইজ্জত আলীর দাবি, তিনিও টাকা পাননি।

কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের এই শংকর মাধবপুর গ্রামে বাড়ি ছিল খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি বীর প্রতীকের। দুই বছর আগে নদীভাঙনে পুরো গ্রাম বিলীন হয়ে যায়।

নদীভাঙনের শিকার ইজ্জত আলীর (৬০) নামও ৫০ হাজার টাকার তালিকায় ছিল। তিনিও কোনো টাকা পাননি।

এই দুজনের কথার সূত্র ধরে অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু নদীভাঙনের শিকার মানুষের পুনর্বাসন সহায়তাই নয়, চর রাজিবপুরে গরিব ও অসহায় মানুষের জন্য আসা বিভিন্ন কর্মসূচির সরকারি বরাদ্দ তাঁরা ঠিকমতো পান না।

গত বছর দেশের ৫৭৭টি উপজেলা ও থানার দারিদ্র্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে বলা হয়েছে, চর রাজিবপুর দেশের সবচেয়ে দরিদ্র উপজেলা। উপজেলার প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন।

প্রধানমন্ত্রীর পুনর্বাসন সহায়তার টাকা লুটপাট

২০২১-২২ অর্থবছরে নদীভাঙনকবলিত মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পুনর্বাসন সহায়তা কর্মসূচি থেকে চর রাজিবপুরের জন্য ৪৮ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অমিত চক্রবর্তীর দাবি, ১০ পরিবারকে ৭৫ হাজার টাকা করে, ১০ পরিবারকে ৬০ হাজার টাকা করে ও ৬৯ পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে—মোট ৮৯ পরিবারের মধ্যে ৪৮ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়।

তবে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে মিলেছে উল্টো চিত্র। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) তালিকা ঘেঁটে দেখা গেছে, শাহ আলম ও ইজ্জত আলীর নাম, ঠিকানা ও জাতীয় পরিচয়পত্র সঠিক। কিন্তু মুঠোফোন নম্বর টাঙ্গালিয়াপাড়ার কবীর হোসেনের।

কবীর উপজেলা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ইউএনও অমিত চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁর ‘বিশেষ সখ্য’। তিনি ইউএনওর প্রতিনিধি হিসেবে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণকাজও তদারক করেন।

রফিকুল ইসলাম পাঁচ বছরে তিনবার নদের ভাঙনের শিকার হয়েছেন। তাঁর নামেও ৫০ হাজার টাকা ওঠানো হয়েছে। কিন্তু রফিকুলও টাকা পাননি। ২৮ ফেব্রুয়ারি মোহনগঞ্জের নয়ারচর নৌকাঘাটে।

মাস্টাররোলে মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের সন্ন্যাসীকান্দি গ্রামের রফিকুল ইসলামের নামের পাশেও কবীরের মুঠোফোন নম্বর। ২৮ ফেব্রুয়ারি নয়ারচর নৌকাঘাটে রফিকুল বলেন, পাঁচ বছরে তিনবার তিনি নদীভাঙনের কবলে পড়েছেন। কিন্তু পাঁচ পয়সাও সাহায্য পাননি।

কবীরের দাবি, বিষয়টি তাঁর জানা নেই। অন্য কেউ তাঁর ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বর মাস্টাররোলে দিতে পারেন।

তালিকাভুক্ত ৮৯ উপকারভোগীর মধ্যে ৩০ জনের বিষয়ে খোঁজ নিয়েছে প্রথম আলো। এতে দেখা যায়, ১৮ ব্যক্তিই কোনো টাকা পাননি। ৮ জন ৩ থেকে ১০ হাজার করে টাকা পেয়েছেন। ৩ জন ১০ থেকে ২০ হাজার এবং ১ জন পেয়েছেন ২৫ হাজার টাকা।

বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুনর্বাসনের এই অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে ইউএনও অমিত চক্রবর্তী জড়িত। তাঁর সঙ্গে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় কয়েকজন সংবাদকর্মী যুক্ত।

৬ মার্চ ইউএনও প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘অ্যাকাউন্ট পে চেক যাঁর অনুকূলে ইস্যু হবে, তিনি টাকা পাবেন। এখানে অনিয়মের সুযোগ নেই। কোনো অনিয়ম হলে পিআইও বলতে পারবেন।’

রাজিবপুরের তৎকালীন পিআইও (অতিরিক্ত দায়িত্ব, বতর্মানের কেন্দুয়ায়) আজিজুল ইসলাম মুঠোফোনে দাবি করেন, কোনো অনিয়ম হয়নি।

তবে জেলা প্রশাসক সাইদুল আরীফ বলেন, তিনি নতুন এসেছেন। খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেবেন।

ভাগাভাগিতে জনপ্রতিনিধি ও নেতারা

রাজিবপুর সদর ইউনিয়নের মেম্বারপাড়ার আবদুল হামিদের নামে পুনর্বাসনের ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়। তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই সরকার তাঁকে দেন ১০ হাজার টাকা।

আবদুল হাইয়ের ভাষ্য, কিছু পরিবারে বাবা-ছেলে আলাদা সংসার। তাই টাকা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। তবে হামিদের দাবি, তাঁর পরিবারে আর কেউ এই টাকা পাননি।

একই গ্রামের হযরত আলীর অভিযোগ, পিআইও অফিসে তাঁর সই করা ৫০ হাজার টাকার চেক কেড়ে নেন ইউপি সদস্য সোহরাব আলী ও শাহাব উদ্দিন। তাঁর ছেলে ফুল মিয়ার ৫০ হাজার টাকার চেকও তাঁরা স্বাক্ষর করিয়ে কেড়ে নেন।

তবে সোহরাব দাবি করেন, যাঁদের নামে চেক, তাঁরাই টাকা পেয়েছেন।

৬ মার্চ হজরত আলীর বাড়িতে গেলে প্রতিবেশীরাও বলেন, পরিবার দুটি একটি টাকাও পাননি। উল্টো ব্যাংক হিসাব খোলা, ছবি তোলাসহ আনুষঙ্গিক ২৫০ টাকা খরচ হয়েছে।

রোস্তম আলী পুনর্বাসনের ৫০ হাজার টাকা মধ্যে ২০ হাজার পেয়েছেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি মোহনগঞ্জের নয়ারচর নৌকাঘাটে।

উপজেলা চেয়ারম্যান আকবর হোসেনের মাধ্যমে মোহনগঞ্জ ইউপির সাবেক সদস্য রোস্তম আলী ২০ হাজার টাকা পান। ৬ মার্চ ইউএনওর কক্ষে আকবর রোস্তমের কম টাকা পাওয়ার বিষয়ে বলেন, নদীভাঙনের শিকার আরও তিন ব্যক্তিকে টাকা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।

তবে কয়েক উপকারভোগী বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান-সদস্যরা চুক্তি করে তাঁদের নাম দিয়েছেন। যেমন কীত্তনটারীর ফরিশ মিয়া ৭৫ হাজারের মধ্যে পান ১০ হাজার টাকা। ৫০ হাজারে ৩ হাজার টাকা পান পশ্চিম রাজিবপুরের ছায়দা বেগম।

গরিবের চালও ভাগাভাগি

সারা দেশে দুস্থ নারীদের জন্য ভালনারেবল উইমেন বেনিফিট (ভিউব্লিউবি) কর্মসূচির চাল বিতরণ শুরু হয়েছে। কিন্তু ভাগাভাগির দ্বন্দ্বে চর রাজিবপুরে এখনো উপকারভোগীদের তালিকা চূড়ান্ত হয়নি।

উপজেলা মহিলাবিষয়ক কার্যালয় বলছে, উপজেলায় এ বছরের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ হাজার ২৯২ নারী প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে পুষ্টিমিশ্রিত চাল পাবেন।

সূত্র জানায়, গত ৮ ডিসেম্বর রাতে ইউএনওর কার্যালয়ে ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যান, দুই ভাইস চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, রাজিবপুর সদর ও কোদালকাটি ইউপি চেয়ারম্যান বৈঠক করেন।

অভিযোগ উঠেছে, বৈঠকে উপজেলা চেয়ারম্যান ৩৯০, দুই ভাইস চেয়ারম্যান ২১০, উপজেলা আওয়ামী লীগ ৩৯০, ইউএনওর কার্যালয় ১১০, ভূমিহীন সমিতি ২০ ও তিন ইউপি ২ হাজার ১৭২ জনের নাম ভাগাভাগি করে নেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অন্তত পাঁচ নারী প্রথম আলোকে বলেন, একটি ভিডব্লিউবি কার্ডের জন্য তাঁদের কাছ থেকে ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়েছে।

রেহেনা বেগম তাঁর স্বামীর নামে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল না পেয়ে শাশুড়িসহ ফিরে আসছেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি চর রাজিবপুরের ব্যাপারীপাড়ায়।

উপজেলা চেয়ারম্যান আকবর ও ভাইস চেয়ারম্যান জায়েদা আমিন ভাগাভাগির বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাইয়ের ভাষ্য, ভাগাভাগি নয়, তাঁরা কিছু নাম সুপারিশ করেছেন।

রাজিবপুর সদর ইউপির চেয়ারম্যান মিরন মো. ইলিয়াছ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ইউনিয়নে ১ হাজার ২৪২ জন ভিডব্লিউবি কর্মসূচির চাল পাবেন। এর মধ্যে তাঁরা ৮০২ নাম জমা দিয়েছেন। বাকি ৪৪০ নাম অন্যরা দিয়েছেন। ভাগাভাগির দ্বন্দ্বে তালিকা করতে দেরি হচ্ছে।

ভিডব্লিউবি প্রকল্পের উপজেলা সভাপতি ইউএনও অমিত চক্রবর্তীর দাবি, কিছু অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় তালিকা অনুমোদনে দেরি হচ্ছে।

কোটালকাটির ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির অভিযোগ করেন, তাঁরা ইউএনওর ভাগাভাগি মেনে গত ডিসেম্বরে তালিকা জমা দিলেও তিনি অনুমোদন না দিয়ে ঘোরাচ্ছেন।

গরু বিতরণেও স্বজনপ্রীতি

সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় চরের মানুষকে ১৫টি বকনা দেয় চর রাজিবপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর। এই গরু বিতরণেও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে।

উপজেলার মদনের চরের বাসিন্দা আনজু আরা, তাঁর শাশুড়ি মরিচ মতি ও ননদ সালেহা বেগম একটি করে বকনা পেয়েছেন।

আনজু প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মামার শ্যালক মরিচাকান্দি গ্রামের গ্রাম্য পশুচিকিৎসক মুকুল হোসেনের মাধ্যমে তাঁরা গরু পেয়েছেন। মুকুল এ প্রকল্পের সদর ইউনিয়নের লাইভস্টক ফিল্ড ফ্যাসিলিটেটর (এলএফএফ)।

শুধু এই তিনজন নন, মুকুলের দাদি বছিরন বেওয়া, মা সহিতন খাতুন, চাচা জামাত আলী, বোন মাধবী লতা, ভাগনে বউ শরিফা খাতুনও একটি করে বকনা পেয়েছেন।

২৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে মুকুলের বাড়িতে গিয়ে দুটি বকনা দেখা যায়। মুকুলের বাবা আবদুল হামিদ দাবি করেন, মাধবী লতা ও শরিফা তাঁদের বাড়িতে বকনা রেখে ঢাকায় গেছেন। মুকুলের দাবি, যাঁরা বকনা পেয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকে দরিদ্র।

চরাঞ্চলে সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের চর রাজিবপুর ইউনিয়নের লাইভস্টক ফিল্ড ফ্যাসিলিটেটর মুকুল হোসেনের বাড়িতে প্রকল্পের দুটি গরু। ইউনিয়নে এ প্রকল্পে বরাদ্দ ১০ গরুর মধ্যে মুকুলের আত্মীয়স্বজনেরা আটটি পেয়েছেন বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ। ২৮ ফেব্রুয়ারি বদরপুর গ্রামে।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মেরাজ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রাজিবপুরে তিনি নতুন। বিষয়টি সম্পর্কে তিনি খোঁজ নেবেন।

চর রাজিবপুরের সাধারণ মানুষ বলেন, সরকারের প্রতিটি কর্মসূচিতে এভাবে ভাগ-বাঁটোয়ারা হচ্ছে। ফলে গরিব মানুষ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাচ্ছে না।

বদরপুরের রাজমিস্ত্রি হজরত আলী ক্ষোভ প্রকাশ করেন, ‘নদীভাঙাদের জইন্য যা বরাদ্দ আসে, তা-ও লুটপাট হয়। দ্যাশ (রাজিবপুর) গরিব থাকব না তো কী থাকব।’