‘স্তন ক্যানসারের কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর রয়েছে। বয়স্ক নারী-পুরুষেরা বেশি ঝুঁকিতে, অর্থাৎ এটা বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। এ ছাড়া নির্দিষ্ট বয়সের আগেই যেসব নারীর ঋতুস্রাব শুরু হওয়া এবং দেরিতে বন্ধ হওয়া, যাঁরা জন্মনিরোধক বড়ি সেবন করে থাকেন, কায়িক শ্রম করেন না, দেহের স্থূলতা নিয়ন্ত্রণ করেন না, বংশের কারও এ ক্যানসার ছিল—তাঁদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি। তাই এ ধরনের ক্যানসার থেকে মুক্ত থাকতে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের বিকল্প নেই।’
বলছিলেন আহ্ছানিয়া মিশন ক্যানসার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. লুবনা মারিয়াম। এসকেএফ অনকোলজির আয়োজনে ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে স্তন ক্যানসার কেন হয়, কীভাবে নির্ণয় করতে হয়, ডায়াগনসিসের বিভিন্ন উপায়, চিকিৎসাব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন ডা. লুবনা মারিয়াম। ২৪ অক্টোবর পর্বটি সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই অক্টোবর মাস কেন ‘স্তন ক্যানসার সচেতনতার মাস’ হিসেবে পালিত হয়, এ বিষয়ে জরুরি কিছু তথ্য দেন উপস্থাপক নাসিহা তাহসিন। এরপর অতিথির কাছে জানতে চান স্তন ক্যানসারের লক্ষণ সম্পর্কে।
উত্তরে ডা. লুবনা মারিয়াম বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট বয়সের পর কারও যদি স্তনে ব্যথাহীন গোটা, বগলের নিচে কোনো ব্যথাহীন চাকা, স্তনের স্কিন বা চামড়া দেবে যাওয়া, লালচে রং ধারণ করা ইত্যাদি থাকে, এগুলোকে আমরা এ ধরনের ক্যানসারের প্রাথমিক উপসর্গ বলে মনে করি। তবে চাকা হলেই ক্যানসার হবে, এমন কোনো কথা নেই। কারণ, এ ধরনের চাকা বা গোটার মধে৵ ১০ শতাংশের ক্যানসার ধরা পড়ে, অন্যগুলো সাধারণ। তাই চাকা হলেই দুশ্চিন্তা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’
স্ক্রিনিং কী এবং কখন করতে হয়? উপস্থাপকের এ প্রশ্নের জবাবে ডা. লুবনা মারিয়াম বলেন, স্ক্রিনিং মানে হলো প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যানসার শনাক্তকরণ। কারণ, রোগ হওয়ার আগে সেটি নির্ণয় করা গেলে দ্রুত চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা যায়। এটা কয়েক ধরনের রয়েছে। প্রথমত সেল্ফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন অর্থাৎ নির্দিষ্ট বয়সের পর একজন নারী নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করবেন। এ সময় অস্বাভাবিক কিছু পেলে তিনি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন। সেখানে তাঁর ক্লিনিক্যাল এক্সামের পর চিকিৎসক আলট্রাসনোগ্রাম করবেন। এরপর মেমোগ্রাম করতে হয়। আর কিছু ক্ষেত্রে এমআরআই করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
ডা. লুবনা মারিয়াম আরও বলেন, স্ক্রিনিংয়ের সঠিক বয়স রয়েছে। সেল্ফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন করতে হয় ২০ বছর বয়সী মেয়েদের মাসিক শেষ হওয়ার দুই দিন পর। যাঁরা ঝুঁকিতে আছেন, তাঁদের এর আগেই করানো উচিত। তবে যাঁদের বয়স ৪০ পেরিয়েছে, তাঁদের এ ধরনের পরীক্ষা করানো জরুরি। আর মেমোগ্রাম করাতে হয় ৪০ বছর বয়স পার হওয়ার পর; কিন্তু ঝুঁকিতে থাকলে বয়স ৩০ হলেই করা উচিত। তবে ঝুঁকিতে থাকুক আর না থাকুক, বছরে একবার মেমোগ্রাম করাতে হবে।
স্তন ক্যানসারের চিকিৎসার ধাপ সম্পর্কে ডা. লুবনা মারিয়াম বলেন, ‘যেকোনো ক্যানসারের ক্ষেত্রে প্রথমে “কোর বায়োপসি” করা হয়, বিদেশে “এফএনএসি” করা হয়। এটার মাধ্যমে ক্যানসারের ধরন জানা যায়। এটা জানার পর ইমেজিং মানে সিটি স্ক্যান, এমআরআই, বোন স্ক্যান, পেট সিটি স্ক্যান করতে পারি। যার মাধ্যমে জানা যায়, ক্যানসারটা কোন পর্যায়ে আছে। পর্যায়টি জানার পর চার পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেওয়া হয়। সেগুলো হলো সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি ও হরমোনথেরাপি। স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, এসব আমাদের দেশের প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থাতেই সম্ভব।’
প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক জানান, এসকেএফ অনকোলজি বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ইউজিএমপি ও অ্যানভিজা ব্রাজিল অনুমোদিত প্ল্যান্ট। ফলে এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় ২৭টি দেশে এবং দক্ষিণ আমেরিকায় রপ্তানি হচ্ছে।
কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির পার্থক্য সম্পর্কে ডা. লুবনা মারিয়াম বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্ত হলে সার্জারি করা হয়। তারপর রেডিওথেরাপি লাগবে কি না, সে ব্যাপারে বিবেচনা করা হয়। কারণ, সার্জারির পর যদি টিউমারের মার্জিন থেকে যায়, তবেই রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়। আর শরীরে যখন মাইক্রোস্কপিক সেল থেকে যায়, সেগুলোকে ধ্বংস করার জন্যই কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ এবং রোগের পর্যায় অনুসারেই এগুলো প্রয়োগ করা হয়।
স্তন ক্যানসারে বয়সের কোনো ব্যাপার আছে কি? এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. লুবনা মারিয়াম বলেন, ‘বয়স বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। বাইরের দেশে এটা ৫০ বছরের পর আর আমাদের দেশে ৪০ বছরের পর হয়ে থাকে।’
ক্যানসার নিয়ে সামাজিক কুসংস্কার বা প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে ডা. লুবনা মারিয়াম বলেন, এসব কুসংস্কার বেশি দেখা যায় নারীদের ক্ষেত্রে। লজ্জায় তাঁরা বলতে চান না। যাঁর ক্যানসার হয়, তিনি ভয়ে থাকেন, ‘আমি মনে হয় বাঁচব না।’ অবিবাহিত নারী বা তাঁর পরিবার চিন্তা করে তাঁর বিয়ে হবে না! এ জন্য প্রয়োজন সচেতনতা বাড়ানো এবং সঠিক শিক্ষা ও তথ্যগুলো সবার সামনে তুলে ধরা। পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, ক্যানসার নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। আর যেহেতু বাংলাদেশেই এখন আন্তর্জাতিক মানের স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা রয়েছে, তাই ক্যানসার হলে এখন আর বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।