চট্টগ্রাম বন্দর ঘিরে ভারী শিল্প ইস্পাত, সিমেন্ট ও কাচ কারখানা গড়ে তুলেছিলেন উদ্যোক্তারা। কাঁচামাল সহজে আনা–নেওয়ার জন্য এখানে কারখানা গড়ে তোলা হলেও এখন উদ্যোক্তারা বেকায়দায় পড়েছেন গ্যাস নিয়ে। গ্যাস–সংকটে কারখানা যেমন মাঝেমধ্যে বন্ধ রাখতে হচ্ছে, তেমনি সক্ষমতার ৫০ ভাগ চালাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের।
উদ্যোক্তারা জানান, গত নভেম্বরে চট্টগ্রামে গ্যাস–সংকট শুরু হয়। এর পর থেকে উৎপাদন ব্যাহত হয়ে আসছিল। বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে কারিগরি ত্রুটির কারণে এলএনজি টার্মিনালে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অনেক কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন উদ্যোক্তারা। শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে টার্মিনালের ত্রুটি সারিয়ে সরবরাহ শুরু হলেও সংকট কাটেনি। গ্যাসের চাপ কম থাকায় ভারী শিল্পে উৎপাদন ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কমেছে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয় বলছে, ২০২৬ সালে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা যাবে। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের আগে দুই বছর চট্টগ্রামের কারখানাগুলো যাতে এমন সংকটে না পড়ে, সে জন্য এখনই বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে।
গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) জানিয়েছে, চট্টগ্রামের ছোট–বড় ১ হাজার ২০০ কারখানায় তারা গ্যাস সরবরাহ দিচ্ছে। চট্টগ্রামে মোট গ্যাসের চাহিদা ৩০ থেকে ৩২ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে শিল্পকারখানায় গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ৮ থেকে ১০ কোটি ঘনফুট। চাহিদা অনুযায়ী দুই–তৃতীয়াংশ পরিমাণ গ্যাসও পাওয়া যাচ্ছে না। কেজিডিসিএলের মহাব্যবস্থাপক আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, একই লাইন থেকে আবাসিক, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। শিল্পে কী পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে, সেটি আলাদা করার সুযোগ নেই। তবে ধারণা করা যায়, শিল্পে অন্তত পাঁচ কোটি ঘনফুট গ্যাস যাচ্ছে।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) মো. কামরুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে আবাসিক গ্রাহকের পাশাপাশি চট্টগ্রামের শিল্পপ্রতিষ্ঠানকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। মহেশখালীর টার্মিনাল ত্রুটি সারিয়ে নেওয়ার পর আগে চট্টগ্রামেই গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে।
শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে টার্মিনালের ত্রুটি সারিয়ে সরবরাহ শুরু হলেও সংকট কাটেনি। গ্যাসের চাপ কম থাকায় ভারী শিল্পে উৎপাদন ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কমেছে।
গ্যাস–সংকটে ভারী শিল্পগুলো কেমন চলছে, তার উদাহরণ দেওয়া যাক। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে মাঝারি আকারের রড কারখানা গোল্ডেন ইস্পাত লিমিটেড। প্রতিদিন ৬০০ টন রড উৎপাদন সক্ষমতার এই কারখানা গ্যাস–সংকটে বৃহস্পতিবার থেকে উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এলএনজি সরবরাহ শুরু হলেও গতকাল রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত কারখানাটি চালু হয়নি। অবশ্য রোববার রাতের মধ্যে কারখানাটি আংশিক চালুর চেষ্টা করছেন কারখানা কর্মকর্তারা। মোস্তফা হাকিম গ্রুপের এই কারখানা ছাড়াও আনোয়ারায় তাদের আরেকটি রড উৎপাদন কারখানা এইচএম স্টিলও চলছে দুই পালায়। দিনে এক হাজার টন উৎপাদন ক্ষমতার এই কারখানায় সক্ষমতার ৫০ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কারখানা কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে মোস্তফা হাকিম গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ সরওয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, চুল্লি গরম করতে যেখানে ৪০ মিনিট সময় লাগত, এখন সেখানে গ্যাসের চাপ কম থাকায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগছে। তাতে গ্যাস–সংকটে উৎপাদন খরচ ১৫–২০ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে। খরচ বেশি হওয়ায় ৫০ শতাংশের বেশি উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না।
এমন সময়ে গ্যাস–সংকট শুরু হয়েছে, যখন ইস্পাতশিল্পে ভরা মৌসুম চলছে। দেশের ৭০ শতাংশের বেশি রডের চাহিদার জোগান দেয় চট্টগ্রামের কারখানাগুলো। শীর্ষ চারটি কারখানার অবস্থানও চট্টগ্রামে। এই চারটি হলো বিএসআরএম গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, কেএসআরএম গ্রুপ ও জিপিএইচ ইস্পাত। এই চারটি কারখানার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নভেম্বর থেকে গ্যাস–সংকটে চারটি গ্রুপের কারখানার উৎপাদন কমেছে ৩০–৩৫ শতাংশ।
গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে আবাসিক গ্রাহকের পাশাপাশি চট্টগ্রামের শিল্পপ্রতিষ্ঠানকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। মহেশখালীর টার্মিনাল ত্রুটি সারিয়ে নেওয়ার পর আগে চট্টগ্রামেই গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে।বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) মো. কামরুজ্জামান খান
ইস্পাত খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস–সংকট তীব্র হওয়ার পর রড তৈরির মধ্যবর্তী কাঁচামাল বিলেট কারখানাগুলো চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এখন রড তৈরির রোলিং মিলে বিকল্প জ্বালানি তেল ব্যবহার করে উৎপাদন সচল রাখা হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
ইস্পাতের মতো সিমেন্টশিল্পেও গ্যাস–সংকটে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সিমেন্টশিল্পে মূলত গ্যাস জেনারেটর চালু রাখতে গ্যাস দরকার। এ ছাড়া কাঁচামাল স্ল্যাগ শুকানোর জন্য গ্যাসের দরকার। রডের মতো বড় অংশীদারি না থাকলেও চট্টগ্রামে বর্তমানে নয়টি সিমেন্ট কারখানা চালু রয়েছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানার ইছানগর এলাকায় ডায়মন্ড সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতির দ্বিতীয় সহসভাপতি আবদুল খালেক পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস–সংকটে গ্যাস জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এতে বিদ্যুৎ ব্যবহারে খরচ বেড়েছে।
গ্যাস–সংকটের প্রভাব পড়েছে কাচশিল্পেও। চট্টগ্রামে দুটি কাচ কারখানার মধ্যে সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ডে পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস কারখানা সচল রয়েছে। পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস–সংকটে চুল্লি চালু রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। গ্যাসের চাপ কম থাকলে পণ্য উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
চুল্লি গরম করতে যেখানে ৪০ মিনিট সময় লাগত, এখন সেখানে গ্যাসের চাপ কম থাকায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগছে। তাতে গ্যাস–সংকটে উৎপাদন খরচ ১৫–২০ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে।মোস্তফা হাকিম গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ সরওয়ার আলম
ভারী শিল্প খাতে গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে একের পর এক সংকট লেগে আছে। ডলার–সংকটে ঋণপত্র খুলে কাঁচামাল আমদানি নিয়ে দুশ্চিন্তা এখনো কাটেনি উদ্যোক্তাদের। এর মধ্যেই গ্যাস–সংকটে উৎপাদন পুরোপুরি চালু রাখা নিয়ে সংশয়ে আছেন উদ্যোক্তারা। তাঁদের মতে, এমন সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে নতুন বিনিয়োগ যেমন কমবে, তেমনি কর্মসংস্থানও বাড়বে না।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যাহত হলে অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ তৈরি হবে। জ্বালানি মন্ত্রণালয় বলছে, ২০২৬ সালে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা যাবে। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের আগে দুই বছর চট্টগ্রামের কারখানাগুলো যাতে এমন সংকটে না পড়ে, সে জন্য এখনই বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে। আমদানি গ্যাসের ওপর পুরোপুরি নির্ভরতা না রেখে জাতীয় গ্রিডের গ্যাস চট্টগ্রামে সরবরাহের বিষয়ে ভাবতে হবে। প্রয়োজনে ভোলা থেকে বিকল্প ব্যবস্থায় চট্টগ্রামের কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহের কথা মাথায় রাখা উচিত।