ছোট শিশুদের মুঠোফোনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক পর্দায় চোখ রাখার সঙ্গে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের সম্পর্ক আছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এক বছর বয়সী শিশুরা ইলেকট্রনিক পর্দায় বেশি সময় কাটালে দুই থেকে চার বছর বয়সে তাদের যোগাযোগ দক্ষতার ও সমস্যা সমাধানে দক্ষতার উন্নতি বিলম্বিত হয়। জাপানের শিশুদের নিয়ে এই গবেষণা হয়েছে।
শিশুরা টেলিভিশন দেখে, ভিডিওতে খেলা করে বা কম্পিউটারের পর্দায় ও মুঠোফোনে কার্টুনসহ নানা কিছু দেখে সময় কাটায়। এ নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা আছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খুব কম বয়সী শিশুদের ইলেকট্রনিক পর্দায় সময় কাটানো নিয়ে অনেক বেশি কথা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, শিশুরা বেশি সময় ধরে ইলেকট্রনিক পর্দায় চোখ রাখলে তাতে তাদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় কি না। গবেষণা বলছে, বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত জাপানের দুটি এলাকায় ৫০টি ক্লিনিকে সেবা নিতে আসা ২৩ হাজার ১৩০ জন মা এবং সমানসংখ্যক শিশুকে এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে ৭ হাজার ৯৭ জন মা ও তাঁদের শিশুদের তথ্য গবেষণার বিশ্লেষণে কাজে লাগানো হয়েছিল। গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ শেষ হয়েছে ২০২৩ সালের মার্চে। এই গবেষণার তথ্য নিয়ে একটি প্রবন্ধ গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত জার্নাল অব আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনে ছাপা হয়েছে।
এক বছর বয়সী শিশুদের নিয়ে গবেষণাটি শুরু হয়েছিল। এই শিশুদের বয়স যখন দুই ও চার বছর হয়েছিল, তখন তাদের মানসিক বিকাশ পরিমাপ ও পর্যালোচনা করা হয়েছিল। বিকাশের ক্ষেত্রে পাঁচটি বিষয় দেখা হয়েছিল—যোগাযোগ, হাঁটাচলার মতো পেশি সঞ্চালন, জিনিসপত্র ধরা বা ছবি আঁকার মতো পেশি সঞ্চালন, বিচার বিবেচনা এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক দক্ষতা।
প্রাথমিক পর্যায়ে গবেষকেরা শিশুর মায়েদের একটি প্রশ্ন করেছিলেন, একটি সাধারণ দিনে আপনি আপনার শিশুকে টেলিভিশন দেখতে বা ভিডিওতে খেলতে, কম্পিউটারে বা মুঠোফোনের পর্দায় কতটা সময় চোখ রাখতে দেন? পাঁচ ধরনের উত্তর দেওয়ার সুযোগ ছিল—কোনো সুযোগ দিই না, এক ঘণ্টার কম, এক ঘণ্টার বেশি, তবে দুই ঘণ্টার কম, দুই ঘণ্টার বেশি তবে চার ঘণ্টার কম এবং প্রতিদিন চার ঘণ্টা বা চার ঘণ্টার বেশি সময়।
কম বয়সী শিশু বেশি সময় ধরেই ইলেকট্রনিক পর্দায় চোখ রাখলে শিশুর বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়—গবেষণায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের সচেতন ও সতর্ক হওয়া উচিত।গোপেন কুমার কুন্ড, অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
৭ হাজার ৯৭টি শিশুর মধ্যে ৫২ শতাংশ ছিল ছেলে ও ৮ শতাংশ ছিল মেয়েশিশু। প্রতিদিন ইলেকট্রনিক পর্দায় সময় কাটানোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ শিশু এক ঘণ্টার কম সময় ব্যয় করে। ২৯ দশমিক ৫ শতাংশ এক ঘণ্টার বেশি ও দুই ঘণ্টার কম সময় ব্যয় করে। ১৮ শতাংশ শিশু দুই ঘণ্টার বেশি ও চার ঘণ্টার কম সময় ব্যয় করে। চার ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় ব্যয় করে ৪ শতাংশ শিশু। যেসব মায়ের বয়স তুলনামূলকভাবে কম, যাঁদের আগে সন্তান হয়নি, যাঁদের পারিবারিক উপার্জন কম, যেসব মায়ের শিক্ষা কম এবং যেসব মা প্রসবের পরে বিষণ্নতায় ভুগেছিলেন, তাঁদের শিশুরা বেশি সময় ধরে ইলেকট্রনিক পর্দায় চোখ রাখে।
গবেষকেরা বলছেন, ইলেকট্রনিক পর্দায় বেশি সময় চোখ রাখার সঙ্গে শিশুর বিকাশ বিলম্বিত হওয়ার ঝুঁকি আছে। কত সময় চোখ রাখলে কোন ধরনের বিকাশ কতটা বিলম্বিত বা বাধাগ্রস্ত হয়, তা বিস্তারিতভাবে গবেষণা প্রবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে।
এক বছর বয়সে বেশি সময় পর্দায় চোখ রাখলে দুই বছর বয়সে শিশুর যোগাযোগ দক্ষতা, ছোট কাজে পেশি সঞ্চালন, বিচার বিবেচনা, ব্যক্তিগত ও সামাজিক দক্ষতায় ঘাটতি পড়ে। অন্যদিকে এক বছর বয়সে বেশি সময় পর্দায় চোখ রাখলে তার বিরূপ প্রভাব চার বছরে স্পষ্ট হয়। চার বছর বয়সে দেখা যায়, ওই সব শিশুর যোগাযোগ দক্ষতা ও সামাজিক জ্ঞানবুদ্ধির ঘাটতি দেখা দেয়। উপসংহারে বলা হচ্ছে, এক বছর বয়সে বেশি সময় ইলেকট্রনিক পর্দায় চোখ রাখার অর্থ দুই ও চার বয়সে শিশুরা যোগাযোগ দক্ষতা ও বিচার–বিবেচনার দক্ষতার সমস্যায় পড়ে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজমের অধ্যাপক গোপেন কুমার কুন্ড প্রথম আলোকে বলেন, কম বয়সী শিশু বেশি সময় ধরেই ইলেকট্রনিক পর্দায় চোখ রাখলে শিশুর বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়—গবেষণায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের সচেতন ও সতর্ক হওয়া উচিত।