জেএন.১ উপধরন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিশ্বজুড়ে অনেকের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি বলেছে, এবারের শীতজুড়ে জেএন.১-সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই।
শীতে ফ্লু ভাইরাস, রাইনোভাইরাস ও শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাসের মতো অন্যান্য মৌসুমি শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাসগুলোর প্রকোপ বেড়ে যায়। তাদের সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে কোভিড-১৯ সৃষ্টিকারী সার্স-কোভ-২ করোনাভাইরাসের আরও একটি পরিবর্তিত উপধরন জেএন.১।
আমরা দেখেছি, করোনার অমিক্রন ধরনের বিভিন্ন উপধরন (যেমন এইচভি.১, ইজি.৫, বিএ.২.৮৬) ২০২২ ও ২০২৩ সালে দাপট দেখিয়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রাণবিয়োগও ঘটেছে করোনায় আক্রান্ত লক্ষাধিক মানুষের। এর মধ্যে প্রাণঘাতী ভাইরাস সার্স-কোভ-২-এর এই অতিসংক্রামক জেএন.১ উপধরন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিশ্বজুড়ে অনেকের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’ (সিডিসি) সতর্ক করে বলেছে, এবারের শীতজুড়ে জেএন.১-এর সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাবে, যার প্রমাণ ইতিমধ্যেই মিলেছে।
এই উপধরন যুক্তরাষ্ট্রে সেপ্টেম্বরে ধরা পড়েছিল। তখন এর সংক্রমণের হার ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৫। এর সংক্রমণ ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে গিয়ে দাঁড়াল ২১ দশমিক ৩ শতাংশে। কিন্তু মাত্র তিন সপ্তাহের ব্যবধানে (২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত) এই সংক্রমণের হার এসে দাঁড়িয়েছে ৪৪ দশমিক ২। সংক্রমণে ডিসেম্বরে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৫০০ মানুষ, যা প্রমাণ করে যে এই উপ-ধরনটি নিঃসন্দেহে আরও বেশি সংক্রমণশীল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এটিকে কড়া নজরে রেখেছে এবং করোনার এই উপধরনকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট’ বা ‘আগ্রহের বৈকল্পিক’ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করেছে। স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন ধরন জেএন.১-এর লক্ষণ আগের ধরনগুলোর মতোই, যেমন জ্বর, সর্দি, কাশি, গলাব্যথা, মাথাব্যথা, স্বাদ বা গন্ধ হারানো, ক্লান্তি ইত্যাদি। এ ছাড়া গুরুতর লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে শ্বাসকষ্ট, বুকব্যথা, ডায়ারিয়া ও বিভ্রান্ত বোধ করা।
সার্স-কোভ-২ ভাইরাস তার আরএনএ-জিনোমের কোড/তথ্যানুযায়ী সাকল্যে ৩০ থেকে ৩২টি প্রোটিন তৈরি করতে সক্ষম, যার মধ্যে ‘স্পাইক’ হলো সবচেয়ে আলোচিত একটি প্রোটিন। এটি করোনাভাইরাসের একটি মূল সংক্রামক উপাদান বা অ্যান্টিজেন। প্রতিটি ভাইরাসের গায়ে কাঁটার মতো স্পাইক প্রোটিন থাকে। এরাই মানুষের কোষঝিল্লিতে অবস্থিত এসিই-২ রিসেপ্টরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে মানবশরীরে প্রবেশ করে কোষগুলো আক্রান্ত করে, নানা উপসর্গ সৃষ্টি করে।
এসব স্পাইকের মিউটেশন বা চরিত্র পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন কোনো ধরন বা উপধরনের সৃষ্টি হয়। অমিক্রনের একটি উপধরন হলো জেএন.১। রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে ফাঁকি দেওয়ায় জেএন.১ আরও অনেক বেশি কার্যকর। ফলে এর সংক্রমণের হার বেশি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে স্পাইক প্রোটিনকে ভিত্তি করেই প্রচলিত সব প্রতিষেধক তৈরি করা হয়েছে। তবে করোনাভাইরাস খুব চালাক প্রকৃতির জীবাণু। প্রতিরোধী ওষুধগুলোর বিরুদ্ধে টিকে থাকার জন্য তাদের বড় একটি হাতিয়ার হলো স্পাইক প্রোটিনের কাঠামোগত পরিবর্তন করা এবং সে কাজ তারা অনায়াসে করে মিউটেশনের মাধ্যমে।
প্রাথমিকভাবে অমিক্রন ধরনের প্রধান উপধরন হিসেবে আমরা দেখেছি বিএ.১ থেকে বিএ.৫ পর্যন্ত পাঁচটি রূপ, যার মধ্যে বিএ.২ ছিল বেশ দাপুটে ও ধ্বংসাত্মক। বিএ.২ বা ‘স্টিলথ ধরন’ নামে পরিচিত অমিক্রনের ওই উপধরনের ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ বেশ উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল। সঙ্গে ভিন্নতর মিউটেশনের ধারায় আরও একটি শাখার উত্থান ঘটেছিল, যা এক্সবিবি নামে অভিহিত। ২০২২ সালে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই এদের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ সংক্রমিত হয়েছিল।
মৃত্যু হয়েছিল প্রায় আড়াই লাখ মানুষের। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিএ.২ ও এক্সবিবি ধরন থেকে বেরিয়ে এসেছে আরও বেশ কিছু উপধরন, তার মধ্যে বেশি সংক্রমণশীল ছিল বিএ.২.৮৬ এবং ইজি.৫। ইজি.৫ শনাক্ত হয়েছিল ২০২৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এবং এর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ প্রায় ৩৮টি দেশে, মারাও গিয়েছিল কয়েক হাজার মানুষ। ভারত ও বাংলাদেশেও এই উপধরন শনাক্ত হয়েছিল। বিএ.২.৮৬ অনেক শক্তিশালী একটি উপধরন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল, কিন্তু মাত্র তিন মাসের মধ্যে বিএ.২.৮৬-কে সরিয়ে জেএন.১ তার পূর্বসূরিদের চেয়েও অধিকতর সংক্রমণশীল হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী দ্রুত বাড়তে থাকা উপধরন জেএন.১। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, বিশ্বজুড়েই নতুন করে চোখ রাঙাচ্ছে করোনার এই সাম্প্রতিকতম রূপ। সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, চীন ও জাপানেও এর সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক হিসাব অনুযায়ী ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত জেএন.১ শনাক্ত হয়েছে ৪৮টি দেশে। আগামী দিনে তা আরও বাড়বে।
আক্রান্তের সংখ্যার পাশাপাশি ঘটছে করোনার এই নতুন উপধরনের কারণে মৃত্যুও। জেএন.১ উপধরনটিতে আক্রান্ত হয়ে এযাবৎ ভারতে সাতজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এবং সেখানে মোট আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। শুধু গত দুই সপ্তাহেই (২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত) বিশ্বব্যাপী অমিক্রন-উদ্ভূত নতুন উপধরনগুলোর কারণে মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ৬৫৪ জনের। বাংলাদেশেও গত ২৩ দিনে (২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত) করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন ৮৩ জন। তবে করোনায় আক্রান্ত ওই ব্যক্তিদের কতজন জেএন.১-এ সংক্রমিত, তা সম্ভবত খতিয়ে দেখা হয়নি। গত তিন বছরে বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণে মারা গিয়েছেন ২৯ হাজার ৪৭৭ জন।
চলতি বছরের প্রথম দিকে বিশ্ব দেখেছে করোনাভাইরাসের অমিক্রন ধরনের উচ্চ সংক্রমণশীল দুটি উপধরন—ইজি.৫ ও বিএ.২ এবং এক্সবিবি-গোত্রীয় উপধরন বিএ.২.৮৬ ছিল সবচেয়ে সংক্রমণযোগ্য। এখন সংক্রমণশীল হয়ে উঠেছে জেএন.১। তার মূলে রয়েছে এটির স্পাইক প্রোটিনে ঘটে যাওয়া বিশেষ এক মিউটেশন (এল৪৫৫এস), যেখানে লিউসিন অ্যামিনো অ্যাসিডের পরিবর্তে প্রতিস্থাপিত হয়েছে সেরিন।
এই মিউটেশন তার পূর্বসূরি বিএ.২.৮৬ ধরনের মধ্যে দেখা যায়নি। দেহের প্রতিরোধব্যবস্থা এড়িয়ে যাওয়া ছাড়াও এই অভিনব মিউটেশনটি প্রচলিত টিকা ও অ্যান্টিবডিগুলোকেও এড়িয়ে যেতে সক্ষম। এর পাশাপাশি বিএ.২.৮৬ ধরনের মতো জেএন.১ উপধরনে স্পাইক প্রোটিনে ৩০টির বেশি অনন্য মিউটেশন রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এস৪৮৬পি, এস৪৫৬এল এবং এস৪৭৮আর। এ ছাড়া এ জাতে নন-স্পাইক উপাদানে আরও কয়েকটি মিউটেশন রয়েছে। এসব মিউটেশন তাদের বংশবৃদ্ধির সুবিধাও দিয়ে থাকে। জেএন.১ যে অতি দ্রুত হারে ছড়াচ্ছে, এর মূলে রয়েছে অধিকহারে মিউটেশন।
কোভিডের ভয়াবহ সময় অতিক্রম করে যখন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে বিশ্ব, ঠিক এ সময়ে নতুন করে করোনাভাইরাস চোখ রাঙাতে শুরু করায় উদ্বেগ তৈরি হয়েছে সর্বত্র। অমিক্রন ধরনের একটি উপধরন জেএন.১ সংক্রমণ ঘিরে বাড়ছে আশঙ্কা। সংক্রমণের হার গত দুই মাসে বিপুল হারে বাড়ছে। এ ছাড়া এ ধরনকে ঘিরে চিন্তাও বেড়েছে চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের। টিকা কি এ ক্ষেত্রে আদৌ কার্যকর? জেএন.১ কতটা বিপজ্জনক, তা নিয়ে এখনো স্পষ্ট করে কিছু বলার মতো সময় আসেনি। ফলে এই ভাইরাস রুখতে বর্তমান টিকার কার্যকারিতা নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা বেশ কঠিন। যদিও কোভিডের সর্বশেষ প্রতিষেধক নিলে এর সংক্রমণের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করা যাবে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
জেএন.১-এর সংক্রমণের হার বেশি হলেও মারণক্ষমতা কম বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী মহল। সেখানে রয়েছে কিছুটা স্বস্তি। কিন্তু ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা দীর্ঘ সময় ধরে কোনো গুরুতর রোগে ভুগছেন বা যাঁদের কোমরবিডিটি রয়েছে এবং যাঁদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হ্রাসকারী কোনো ওষুধ খেতে হয়, তাঁদেরও বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক অতীতের সব সতর্কতা সবার তো জানাই আছে।
যেমন জনবহুল এলাকায় মাস্ক পরা, নিয়মিত হাত পরিষ্কার করা, ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, নিভৃতবাস, লক্ষণ দেখা দিলে পরীক্ষা করানো ইত্যাদির মাধ্যমে কোভিড-সংক্রমণ অনেকটাই আটকে দেওয়া সম্ভব। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই।
অধ্যাপক রাশিদুল হক: সাবেক অধ্যাপক, এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র