সর্বোচ্চ গ্যাস সরবরাহের পরও বাড়ছে না বিদ্যুতের উৎপাদন। রাজধানীতে বিদ্যুতের সরবরাহে তেমন কোনো ঘাটতি নেই। গ্রামে লোডশেডিং বেশি হচ্ছে।
দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে ২২ এপ্রিল রাত ৯টায়। ওই সময় উৎপাদন হয়েছিল ১৬ হাজার ২৩৩ মেগাওয়াট। একই সময়ে লোডশেডিং হয়েছে ৪৪৬ মেগাওয়াট। এরপর এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিনই বাড়ছে লোডশেডিং। এর মধ্যে গতকাল সোমবার ঘণ্টায় সর্বোচ্চ লোডশেডিং হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট। উৎপাদন করা হচ্ছে ১৩ হাজার থেকে সাড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত। চাহিদা আছে সাড়ে ১৩ হাজার থেকে ১৭ হাজার মেগাওয়াট। গতকাল দিনের বেলায় ঘণ্টায় তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং করতে হয়েছে।
ঢাকার বাইরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পিডিবি, ওজোপাডিকো, নেসকো ও আরইবি। এর মধ্যে দেশের অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলে সরবরাহ করে আরইবি। লোডশেডিংয়ে ভুগছে মূলত এ সংস্থার গ্রাহকেরা। মোট বিদ্যুৎ গ্রাহকের ৫৫ শতাংশই এ সংস্থার অধীন।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত লোডশেডিংয়ের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছানো বিতরণ সংস্থার হিসাবেও বাড়তি লোডশেডিংয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। পিজিসিবির হিসাবে গতকাল সর্বোচ্চ লোডশেডিং ছিল ৩ হাজার ১৯৬ মেগাওয়াট, এটি বেলা দুইটায়। এরপর তিনটার দিকে লোডশেডিং কিছুটা কমে হয় ৩ হাজার ৩৪ মেগাওয়াট। একই সময়ে দেশের সবচেয়ে বড় বিতরণ সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) একাই লোডশেডিং করেছে ৩ হাজার ৪৮৩ মেগাওয়াট।
পিডিবির দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, কয়েক দিন ধরে গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ায় পরিস্থিতি সামলানো যাচ্ছে না। এর মধ্যে গতকাল সকাল ৮টা ৪৯ মিনিটে বন্ধ হয়ে যায় সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহকারী ভারতের ঝাড়খন্ডের আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্র। পিজিসিবির গ্রিডে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি থাকায় ওই সময় কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। বেলা ১টা ৪২ মিনিটে বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট উৎপাদন শুরু করে। উৎপাদন ধীরে ধীরে বাড়াচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে ময়মনসিংহ অঞ্চলে। এরপর চট্টগ্রাম, রংপুর, কুমিল্লা, রাজশাহী, সিলেট অঞ্চল ছাড়াও ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বরিশাল অঞ্চলেও কিছুটা লোডশেডিং হয়েছে।
রাজধানীতে বিদ্যুৎ সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই বলে জানিয়েছে ঢাকার দুই বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা ডিপিডিসি ও ডেসকো। তবে কারিগরি কারণে কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ–বিভ্রাট হচ্ছে। এতে করে দিনে ৩০ মিনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ না পাওয়ার অভিযোগ আছে গ্রাহকদের। এ ছাড়া গ্রিডের ত্রুটির কারণে গতকাল বসুন্ধরা ও আশপাশের এলাকায় কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারেনি ডেসকো। দুপুরের পর সরবরাহ শুরু হয় ওই এলাকায়।
ঢাকার বাইরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পিডিবি, ওজোপাডিকো, নেসকো ও আরইবি। এর মধ্যে দেশের অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলে সরবরাহ করে আরইবি। লোডশেডিংয়ে ভুগছে মূলত এ সংস্থার গ্রাহকেরা। মোট বিদ্যুৎ গ্রাহকের ৫৫ শতাংশই এ সংস্থার অধীন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক সহকারী ম তামিম বলেন, জ্বালানির অভাব নিয়েও হয়তো সহনীয় লোডশেডিং থাকত। অস্বাভাবিক গরমের কারণে চাহিদা বাড়ায় ঘাটতি আরও বেড়ে গেছে।
গরমের সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়ছে। জ্বালানি তেলচালিত কেন্দ্র থেকে লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে আদানির কেন্দ্র থেকে সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় গতকাল ঘাটতি বেশি হয়েছে।পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন
বড় বিদ্যুৎ–ঘাটতি পাচ্ছে আরইবি
আরইবির দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, গতকাল বেলা তিনটার দিকে আরইবির বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়ায় ৯ হাজার ৪৮০ মেগাওয়াট। এ সময় তারা সরবরাহ পেয়েছে ৫ হাজার ৯৯৭ মেগাওয়াট। ৩৭ শতাংশ ঘাটতি তারা পূরণ করেছে লোডশেডিং দিয়ে। এতে দেশের একটি বড় অংশের গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ পাননি মানুষ। সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে ময়মনসিংহ অঞ্চলে। এরপর চট্টগ্রাম, রংপুর, কুমিল্লা, রাজশাহী, সিলেট অঞ্চল ছাড়াও ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বরিশাল অঞ্চলেও কিছুটা লোডশেডিং হয়েছে।
পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাস ও কয়লা থেকে পরিকল্পনামতো উৎপাদন হচ্ছে। তবে বকেয়া বিলের জটিলতায় তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পুরোদমে উৎপাদন করা যাচ্ছে না। জ্বালানি তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এটি তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি করা যাচ্ছে না।
পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গরমের সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়ছে। জ্বালানি তেলচালিত কেন্দ্র থেকে লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে আদানির কেন্দ্র থেকে সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় গতকাল ঘাটতি বেশি হয়েছে।
দিনেরাতে আট ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হচ্ছে।বগুড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর মহাব্যবস্থাপক মোনয়ারুল ইসলাম ফিরোজী
শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত, বাড়তি খরচ
শিল্পকারখানায় লোডশেডিং না করার জন্য সরকারের নির্দেশনা থাকলেও তা পুরোপুরি মানা সম্ভব হচ্ছে না। গাজীপুর মহানগরের নাওজোড় এলাকার তোহা ফ্যাশন লিমিটেড কারখানার মহাব্যবস্থাপক কবিরুল হাসান বলেন, ছয় থেকে সাত ঘণ্টা লোডশেডিং থাকে। জেনারেটর চালু রাখতে আগে মাসে ১৫ লাখ টাকার ডিজেলে লাগত, এখন ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা লাগছে।
বগুড়া বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি আজিজার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে শিল্পকারখানায় উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে।
গড়ে ৩০ শতাংশ বিদ্যুতের সরবরাহ কম পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বগুড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর মহাব্যবস্থাপক মোনয়ারুল ইসলাম ফিরোজী। তিনি বলেন, দিনেরাতে আট ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
গ্রামে গরমে ভুগছেন মানুষ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় দুই দিন ধরে ঘণ্টায় বিদ্যুতের চাহিদা ১৫০ থেকে ১৮০ মেগাওয়াট। সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে ১০২ থেকে ১১৮ মেগাওয়াট। জেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক মো. মকবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রোববার লোডশেডিং ছিল ৫৬ শতাংশ। নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার পাগলা গ্রামের কৃষক জীবন দেবনাথ বলেন, রোববার বিকেল চারটা থেকে গতকাল বিকেল চারটা পর্যন্ত ১১ বার বিদ্যুৎ গেছে।
জেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মাসুম আহমেদ বলেন, ১২০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ হচ্ছে ৫৮ মেগাওয়াট।
গ্রামের বিত্তহীন মানুষদের কেউ কেউ ৮০ ভাগ সময় বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। সামাজিকভাবে এটা অন্যায়।ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম
ফেনীর সোনাগাজী উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় কয়েকজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লোডশেডিং নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য দেন সম্প্রতি। উপজেলার ভাদাদিয়া এলাকার সুমন শর্মা বলেন, প্রতিদিন তিন থেকে চার ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ থাকে না।
উপজেলায় ২৫ থেকে ৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদার বিপরীতে ৫ থেকে ৭ মেগাওয়াট সরবরাহ পাচ্ছেন বলে জানান ফেনী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির উপমহাব্যবস্থাপক বলাই মিত্র।
সারা দেশের লোডশেডিং পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, প্রকৃত লোডশেডিং আরও বেশি। গ্রামের বিত্তহীন মানুষদের কেউ কেউ ৮০ ভাগ সময় বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। সামাজিকভাবে এটা অন্যায়।
[তথ্যসহায়তায় প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট জেলার প্রতিনিধিরা]