বোন ও বাবা-মায়ের জন্য গরুর মাংস কিনতে আজ মঙ্গলবার চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট বাজারে আসেন তরুণ রাকিবুল ইসলাম। হাড় ছাড়া এক কেজি গরুর মাংস কিনেছেন। দাম পড়েছে ৮৫০ টাকা। দর-কষাকষি করেও দাম কমাতে পারেননি। বাধ্য হয়ে বিক্রেতার চাওয়া দামেই কিনতে হয়েছে। রাকিবুল বলেন, তাঁর ক্ষুদ্র ব্যবসার ওপর ভর করেই সংসার চলে। বাজারে সবকিছুর দাম বাড়তি। যত দিন যাচ্ছে, খরচ বাড়ছে। তবে পরিবারের সকলের ইচ্ছা, তাই এক কেজি গরুর মাংস নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
বিভিন্ন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে গরুর মাংসের চাহিদা বাড়ে। সেই সুযোগে বেশি দামে মাংস বিক্রি করেন বিক্রেতারা। এতে ভোগান্তিতে পড়েন নিম্ন আয়ের মানুষ। উপলক্ষগুলোতে বাজারে এসে দাম শুনেই হতাশ হয়ে পড়েন তাঁরা। দামের দিক দিয়ে মধ্যবিত্তদেরও হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে গরুর মাংস।
চট্টগ্রামে নিম্ন ও মধ্য আয়ের অধিকাংশ মানুষ বাজার করেন চকবাজার ও বহদ্দারহাট বাজার থেকে। চলতি মাসে এই দুই বাজারে কেজিপ্রতি হাড়সহ গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে গড়ে ৬৮০ থেকে ৭২০ টাকায় এবং হাড় ছাড়া গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে গড়ে ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকায়। তবে আজ মঙ্গলবার সকালে বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারে গরুর মাংসের দোকানগুলোতে গিয়ে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। শবে বরাত উপলক্ষে আজকের দিনে হাড়সহ গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকায় এবং হাড় ছাড়া গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৮৫০ টাকায়। বাজারের বাইরে অলিগলির দোকানে দাম চাওয়া হচ্ছে ৯০০ টাকাও। চট্টগ্রামে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে অন্তত ৫০ টাকা।
নগরের চকবাজার এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৫০ গ্রাম গরুর মাংস বিক্রি শুরু হলেও নিম্ন আয়ের মানুষ এখনো মাংস কিনতে দুবার ভাবছেন। শবে বরাতে গরুর মাংস খাওয়ার শখ থাকলেও অনেকেই ২৫০ গ্রাম মাংসের জন্য বলতে সংকোচ বোধ করছেন। কয়েক মাস ধরে গরুর মাংসের পাশাপাশি মুরগি ও ছাগলের মাংসের দামও বাড়তি। তাই উৎসব-উপলক্ষ আসলেও মাংস খাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।
চট্টগ্রাম কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদন ও টিসিবির তথ্য বলছে, দেশের বাজারে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গরুর মাংসের জাতীয় গড় খুচরা দর ছিল প্রতি কেজি ৩১৭ টাকা। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সে দাম বেড়ে দাঁড়ায় গড় ৪১৯ টাকায়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে গরুর মাংসের গড় দাম পৌঁছেছে ৭৫০ টাকার ঘরে।
সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের বাজারগুলোতে ২০২১ সালে মার্চ মাসে গড় গরুর মাংসের দাম ছিল ৫৫০ থেকে ৫৬০ টাকা। পরের বছর একই মাসে তা ৭০০ থেকে ৭২০ টাকা হয়ে যায়। সর্বশেষ চলতি মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে গড়ে ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে সারা দেশে পশুর উৎপাদন আগের অর্থবছরের চেয়ে তিন লাখ ৯৯ হাজার বেড়ে হয় ৫ কোটি ৬৩ লাখ ২৮ হাজার। এর মধ্যে ৪৪ শতাংশই গরু। দেশে জনপ্রতি মাংসের চাহিদা দৈনিক ১২০ গ্রাম। সে হিসাবে বছরে মাংসের চাহিদা ৭৪ লাখ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন। দেশে ২০২০-২১ অর্থবছরে মাংসের উৎপাদন ছিল ৮৪ লাখ ৪০ হাজার টন। অর্থাৎ মাংসের উদ্বৃত্ত ১০ লাখ টন।
চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শবে বরাত, শবে কদর ও রমজানে চট্টগ্রামে গরুর মাংসের চাহিদা বেশি। অনেক ব্যবসায়ী কোরবানির সময় বিক্রি করার জন্য গরু রেখে দেন। ফলে উপলক্ষগুলোতে চাহিদার তুলনায় জোগান কম হয়। এই সুযোগে কিছু বিক্রেতা বাড়তি দাম হাতিয়ে নেন।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, উৎসব কিংবা উপলক্ষে দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের ভোগান্তিতে ফেলা হয়। উৎসবকে কেন্দ্র করে দাম বাড়িয়ে পরবর্তী সময়ে সেই দাম আর কমে না। বাজারে এখন মাংসের দাম অনেক বেশি। বিক্রেতারা খাবার, পরিবহন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ বাড়তি দেখিয়ে মাংসের দাম বাড়িয়ে দেন। দেখা যায়, যেখানে তাঁদের উৎপাদন খরচ ১০ থেকে ২০ শতাংশ বাড়ে, সেখানে তাঁরা ক্রেতাদের কাছ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়তি নিচ্ছে। এসব থেকে পরিত্রাণের উপায় শুধু জরিমানা নয়। যেসব ব্যবসায়ী বাড়তি দামে পণ্য বিক্রি করে তাঁদের আইনের আওতায় এনে আরও কঠোর শাস্তি দেওয়া হলে অন্যরা সতর্ক হবে।
মুরগির দামও বাড়তি
এই বাড়তি দাম শুধু গরুর মাংসের ক্ষেত্রে নয়। বাজারে ব্রয়লার ও ছাগলের মাংসের দামও নেওয়া হচ্ছে বাড়তি। চট্টগ্রামে বাজারভেদে দেখা গেছে বিক্রেতাদের অস্বাভাবিক দাম নেওয়া। কোনো নির্দিষ্ট মূল্যতালিকা না থাকায় বিক্রেতারা উৎসব উপলক্ষকে কেন্দ্র করে নিচ্ছেন বাড়তি দাম। এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ ক্রেতারা। বাজারে কেজিপ্রতি ব্রয়লার বিক্রি হচ্ছে ২৪০ থেকে ২৫০ টাকায়, সোনালি মুরগি ৩২০ থেকে ৩৪০ টাকা, দেশি মুরগি ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা ও ছাগলের মাংস বিক্রি হচ্ছে এক হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায়। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, গত এক বছরে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ। ছাগলের মাংসের দাম বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ এবং ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে প্রায় ৪৯ শতাংশ।
বাজারে তদারকির বিষয়ে জোর দিয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, উৎসবকে কেন্দ্র করে কোনো বাজারে দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে, এমন অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রমজান মাসকে কেন্দ্র করে জেলা প্রশাসনের ৪০টি (উপজেলায় ৩০টি ও নগরে ১০টি) দল কয়েক দিনের মধ্যে বাজার পরিদর্শন শুরু করবেন বলেও জানান তিনি।