রোকেয়া সরণিতে চলছে সংস্কারকাজ।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চাকচিক্য থাকবে না।
২০৩০ সালের মধ্যে ছয়টি পথে মেট্রোরেল চালুর লক্ষ্য।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ–চালিত মেট্রোরেলব্যবস্থার যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে ২৮ ডিসেম্বর। ওই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর গণপরিবহনের এই নতুন দিগন্তের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। তবে সাধারণ যাত্রীদের মেট্রোরেলে উঠতে আরও এক দিন অপেক্ষা করতে হবে। এখন পর্যন্ত যে পরিকল্পনা, সে অনুযায়ী উদ্বোধনের পরদিন থেকে টিকিট কেটে তাঁরা মেট্রোরেলে চড়তে পারবেন।
মেট্রোরেল উদ্বোধনে দুই হাজার অতিথি নিয়ে অনুষ্ঠান হবে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। প্রধানমন্ত্রী প্রথম টিকিট কেটে ট্রেনে চড়বেন।
ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। গতকাল শুক্রবার বিজয় দিবসের ছুটির দিনও প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠক করেছেন। সূত্র বলছে, আগামীকাল রোববার জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা, মেট্রোরেলের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও পরামর্শকদের নিয়ে চূড়ান্ত বৈঠক হবে। ওই দিনই সাধারণ মানুষের জন্য কবে থেকে টিকিট বিক্রি শুরু হবে, তা জানানো হবে।
ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি হবে শেরেবাংলা নগরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। পুরো কেন্দ্রটি মেট্রোরেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া নেওয়া হয়েছে। এ অনুষ্ঠানে দুই হাজার অতিথি থাকবেন। মন্ত্রিসভার সদস্য, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, সরকারি কর্মকর্তা, দিল্লি মেট্রোরেলের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাসহ বিভিন্নজনকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর কথা রয়েছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের যে প্রাথমিক পরিকল্পনা করা হয়েছে, তা থেকে জানা যায়, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতাসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগারগাঁও স্টেশনে (আইডিবি ভবনের কাছে) যাবেন। সেখান থেকে তিনি প্রথম যাত্রী হিসেবে টিকিট কেটে ট্রেনে চড়বেন। প্রধানমন্ত্রী স্থায়ী কার্ডের মাধ্যমে টিকিট কাটবেন বলে জানা গেছে। এরপর তিনি ট্রেনে চড়ে উত্তরা উত্তর (উত্তরায় মেট্রোরেলের ডিপোর কাছে) স্টেশনে গিয়ে নামবেন, যেটি সর্বশেষ স্টেশন। সেখানে মেট্রোরেলের উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করবেন। সেখানকার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে প্রধানমন্ত্রী আবার মেট্রোরেলে চড়ে আগারগাঁও চলে আসবেন। ট্রেন থাকা অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলবেন ও ছবি তুলবেন।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন যেমন সারা দেশে উদ্যাপন করা হয়েছে, তেমন পরিকল্পনা মেট্রোরেলের ক্ষেত্রে এখনো নেই। ডিএমটিসিএল কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্বের প্রায় সব দেশই তাদের প্রথম মেট্রোরেল চালুর উপলক্ষটি বর্ণাঢ্যভাবে উদ্যাপন করে থাকে। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সরকার ব্যয় কমাতে উদ্যোগী হয়েছে। এ জন্য মেট্রোরেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি পদ্মা সেতুর মতো না–ও হতে পারে। মেট্রোরেল যেহেতু ঢাকাকেন্দ্রিক একটি প্রকল্প, এ জন্যে এর উদ্যাপন ঢাকা ও এর আশপাশেই সীমাবদ্ধ রাখার চিন্তা আছে কর্তৃপক্ষের।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বিষয়ে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এন এ সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, মেট্রোরেল চালুর মুহূর্তটির জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। বাড়তি চাকচিক্য না থাকলেও উদ্বোধনী অনুষ্ঠান খুব ভালোভাবে করার জন্য চেষ্টা থাকবে। তিনি জানান, নিরাপত্তা ও নানা আনুষ্ঠানিকতার কারণে উদ্বোধনের দিন জনসাধারণের মেট্রোরেলে চড়ার সুযোগ রাখা হচ্ছে না। সাধারণ মানুষ পরদিন মেট্রোরেলে উঠতে পারবে।
ঢাকার উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১ কিলোমিটারের কিছু বেশি দৈর্ঘ্যের প্রথম মেট্রোরেল (এমআরটি লাইন-৬) প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১২ সালে। ২৮ ডিসেম্বর এই পথের একাংশ, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চালু হচ্ছে। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশ আগামী বছরের শেষ দিকে চালুর পরিকল্পনা আছে।
মতিঝিল থেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত অংশ চালু হতে পারে ২০২৫ সালে। এমআরটি লাইন-৬ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকায়। এর মধ্যে জাইকা দিচ্ছে ১৯ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা। সরকার ব্যয় করছে ১৩ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা।
মেট্রোরেল চালু হলে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। পাশাপাশি যাত্রাও হবে আরামদায়ক। ২০১৭ সালে যখন মেট্রোরেলের কাজ শুরু হয়, তখন বেগম রোকেয়া সরণির সড়কের একাংশ বন্ধ হয়ে যায়। পাঁচটি বছর মানুষ ব্যাপক ভোগান্তিতে কাটিয়েছে। রোকেয়া সরণিতে গত দুদিন গিয়ে দেখা যায়, সড়কে বিভিন্ন জায়গায় সংস্কারকাজ চলছে। সড়ক বিভাজকে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করছেন কর্মীরা। মেট্রোরেল স্টেশনগুলোর কাজ প্রায় শেষ। তবে রাতে রোকেয়া সরণিতে অন্ধকার নেমে আসে। কারণ, সড়কবাতি নেই।
কাজীপাড়ার একটি আসবাব বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের কারণে পাঁচ বছর মানুষের ভোগান্তি যেমন হয়েছে, তেমনি ব্যবসারও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্রেতারা মিরপুরে আসতে চাইতেন না। মেট্রোরেলের মতো একটি প্রকল্পের কারণে আমরা সেটা মেনে নিয়েছি।’ তিনি বলেন, এখন সহজে মানুষ চলাচল করতে পারবে। এটাই বড় স্বস্তি।
সরকার মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া ঠিক করেছে ২০ টাকা। আর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া হবে ১০০ টাকা। দূরত্বভেদে ভাড়া ভিন্ন হবে। স্থায়ী কার্ড কিনে মেট্রোরেলের টিকিট কাটা যাবে। এর জন্য সময় সময় টাকা ঢোকাতে (রিচার্জ) হবে। এ ছাড়া তাৎক্ষণিকভাবে স্টেশন থেকেও টিকিট কাটা যাবে।
ডিএমটিসিএলের তথ্যমতে, শুরুর দিকে রাজধানীর উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও যেতে সময় লাগবে প্রায় ২০ মিনিট। পরে সময় ১৬ থেকে ১৭ মিনিটে নেমে আসবে। উদ্বোধনের পর দুই থেকে তিন মাস কম যাত্রী নিয়ে চলাচল করবে ট্রেনগুলো। প্রথম দিকে সকালে কিছুক্ষণ, আবার বিকেলে কিছুক্ষণ ট্রেন চলবে। সব মিলিয়ে দিনে চলবে পাঁচটি ট্রেন। যদিও একটা সময় প্রতি চার মিনিট পরপর ট্রেন চলার কথা রয়েছে।
ঢাকা শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার যানজট নিরসনে সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ছয়টি মেট্রোরেলের মাধ্যমে একটি যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে। এর একটি উত্তরা থেকে মতিঝিল হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত, যার একাংশ চালু হতে যাচ্ছে।
মেট্রোরেল লাইন-৬ পুরোপুরি চালু হলে শুরুতে দৈনিক ৪ লাখ ৮৩ হাজার যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে বলে জানিয়েছে ডিএমটিসিএল। ছয়টি মেট্রোরেল লাইন চালু হলে দৈনিক ৫০ লাখ যাত্রী পরিবহন করা যাবে। শুধু লাইন-৬ চালু হলে ঢাকায় কার্বন নিঃসরণ ২ লাখ টনের মতো কমবে।
লাইন-৬–এর পর কাজ শুরু হবে লাইন-১–এর। এমআরটি লাইন-১-এর দুটি পথ। প্রথমটি কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত। এটি পুরোপুরি পাতালপথে হবে। দ্বিতীয় পথটি যাবে নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত, যা হবে উড়ালপথে। পুরো মেট্রোটি নির্মাণে খরচ হবে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা, ২০২৬ সালে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
লাইন-১–এর নির্মাণ প্রকল্পে গত অক্টোবরে জাপান, ফ্রান্স, ভারত ও বাংলাদেশের আট প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মূল নির্মাণকাজ আগামী জুনে শুরু হতে পারে বলে জানা গেছে।
মেট্রোরেল লাইন-৫ (উত্তর রুট) সাভারের হেমায়েতপুর থেকে শুরুর পর মিরপুর ১০ নম্বর সেকশন ও গুলশান হয়ে ভাটারা যাবে। মেট্রোরেল লাইন-৫ (দক্ষিণ রুট) গাবতলী থেকে মিরপুর রোড ধরে গিয়ে পান্থপথ, হাতিরঝিল, রামপুরা, আফতাবনগর থেকে দাশেরকান্দি গিয়ে থামবে।
লাইন-২ শুরু হবে গাবতলী থেকে। এরপর বছিলা, মোহাম্মদপুর, ঝিগাতলা, নিউমার্কেট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, গুলিস্তান, আরামবাগ, কমলাপুর, মুগদা হয়ে চট্টগ্রাম রোডে গিয়ে শেষ হবে। এমআরটি লাইন-৪ হবে কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত।
সব মিলিয়ে ছয়টি মেট্রোরেল লাইন ২০৩০ সালের মধ্যে চালুর পরিকল্পনা থাকলেও সে অনুযায়ী কাজ এগোয়নি। ফলে এ সময়ে প্রকল্পগুলো নেওয়া, নির্মাণকাজ করা ও মেট্রোরেল চালু সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।