‘যক্ষ্মা হলে নেইকো ভয়/ সবাই মিলে করব জয়’ স্লোগানে সারা দেশের স্কুলশিক্ষার্থীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াড। আজ শুক্রবার রাজধানীর বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াড। অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, যক্ষ্মা এখন আর আতঙ্ক নয়। সচেতনতা আর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এই রোগ পুরোপুরি নিরাময় হয়।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) পরিচালনায় প্রথম আলো স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা–সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য ছড়িয়ে দিতে এবং যক্ষ্মারোগের বিস্তার রোধ ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইউএসএআইডির সহায়তায় প্রচার চালিয়ে আসছে।
অলিম্পিয়াডের জাতীয় পর্বে অংশ নেয় ৫৫০ শিক্ষার্থী। এর আগে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১২টি জেলায় আঞ্চলিক অলিম্পিয়াড এবং সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইনে কুইজ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে বিজয়ীরা আজ জাতীয় স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াডে অংশ নেয়।
বিকেলে সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘নাগরিকেরা সুস্থ না হলে জাতি সুস্থ হবে না। এ জন্য শৈশব থেকেই স্বাস্থ্যবিষয়ক জ্ঞানার্জন জরুরি। সমাজকে পরিবর্তনের জন্য সম্মিলিত প্রয়াস দরকার। এসব কারণে এই স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াড খুবই গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন। ইতিমধ্যে তোমরা দেশ গড়ার সংগ্রামে অংশ নিয়েছ।’
উপদেষ্টা বলেন, জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের যে সুযোগ এসেছে, সেখানে সবার অংশগ্রহণ জরুরি। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এ জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, বায়ুকে নির্মল রাখা, পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে পলিথিন–প্লাস্টিক বর্জন, এমন অনেক কিছুর অভ্যাস রপ্ত করতে হবে। নতুন প্রজন্ম এখন অনেক কিছুর সঙ্গে যুক্ত থাকে। তারাই দেশকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নেবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্যে দিয়ে সমাপনী পর্ব শুরু হয়। এই পর্বে স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন বলেন, যক্ষ্মা অনেক পুরোনো রোগ। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা। আগের দিনে ভালো চিকিৎসাব্যবস্থা ছিল না বলে আতঙ্ক ছিল। এখন অনেক ভালো ওষুধ পাওয়া যায়। রোগের পরীক্ষাও করা যায় খুব দ্রুত। দেশের প্রতিটি উপজেলা, এমনকি অনেক ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিনা খরচে যক্ষ্মার পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। সরকারি হাসপাতাল ও অনেক বেসরকারি সংস্থার চিকিৎসাকেন্দ্রে বিনা মূল্যে ওষুধ পাওয়া যায়। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ওষুধ সেবনে যক্ষ্মা সম্পূর্ণ নিরাময় হয়।
ইউএসএআইডির আইডি টিম লিড সামিনা চৌধুরী বলেন, শুধু মানুষকে নয়, সব সৃষ্টি জীব, পরিবেশ, প্রকৃতি সবাইকে ভালোবাসতে হবে। তাহলে নিজে আলোকিত হওয়া যাবে, সমাজও আলোকিত হবে।
আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, যক্ষ্মা সংক্রামক রোগ। কফ–কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। যত্রতত্র থুতু, কফ কাশি ফেলা যাবে না। এসব শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে।
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রোগ্রাম ব্যবস্থাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর কবির বলেন, যক্ষ্মা প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মায় মৃত্যুর সংখ্যা ৯৫ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে। এ জন্য জনসচেতনতা খুব জরুরি।
যক্ষ্মা এখনো দেশের স্বাস্থ্য খাতের প্রধান সমস্যা উল্লেখ করে আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও প্রোগ্রাম অন ইমার্জিং ইনফেকশন্স বিভাগের প্রধান সায়েরা বানু বলেন, প্রতিবছর দেশের তিন লাখ মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। এর মধ্যে প্রায় ৪২ হাজার মারা যান। দেশে কোভিডের চেয়েও যক্ষ্মায় মৃত্যু বেশি। অথচ রোগটি নিরাময়যোগ্য। শিক্ষার্থীরা এই আয়োজন থেকে যক্ষ্মা সম্পর্কে যে জ্ঞান লাভ করেছে, তা তারা নিজেদের এলাকায় ছড়িয়ে দিলে জনসচেতনতা বাড়বে।
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে একটি বড় কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন দেশকে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক উদ্যোগের প্রয়োজন। স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াডের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে যক্ষ্মারোগসহ স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করা হয়েছে। প্রথম আলো এমন উদ্যোগ অব্যাহত রাখবে। তিনি অলিম্পিয়াডের সব সহযোগী, অংশীজন, শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের ধন্যবাদ জানান।
দুপুরে দ্বিতীয় পর্বের শুরুতে ছিল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রশ্নোত্তর পর্ব। এতে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন লাং ফাউন্ডেশনের মহাসচিব ডা. আসিফ মুজতবা মাহমুদ, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. তানজিনা হোসেন, বিএসএমএমইউর সহকারী অধ্যাপক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্তী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক বি এম মইনুল হোসেন, আইসিডিডিআরবির ডা. অং ক্য জাই মগ ও ডা. শাহরিয়ার আহমেদ এবং প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক।
এর আগে সকালে নাম নিবন্ধন দিয়ে শুরু হয় অলিম্পিয়াডের কার্যক্রম। একাডেমি প্রাঙ্গণের পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে বিভিন্ন জেলার প্রতিযোগীদের জন্য সাজানো হয়েছিল স্টলের সারি। সেখান থেকে প্রতিযোগীরা উপহার নিয়ে মিলনায়তনে ঢোকে। এরপর ছিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। সবাইকে স্বাগত জানান প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সমিশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়কারী মুনির হাসান ও আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ পরামর্শক অঞ্জন সাহা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ হলে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশ নেয়। এরপর শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অয়ন চাকলাদার ও তার দলের শিল্পীরা পরিবেশন করেন, ‘আমি বাংলার গান গাই’, ‘আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে’, ‘এমন যদি হতো’। পরে মজার মজার জাদু দেখিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন জাদুশিল্পী যুবরাজ।
এই আয়োজনে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় ছিল ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা ও আইসিডিডিআরবির কর্মকর্তা জাহিদ হোসাইন খান।
সেরা যারা: স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রাথমিক, জুনিয়র ও সেকেন্ডারি—এই তিন বিভাগে। প্রতিযোগিতায় প্রাথমিকে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বগুড়ার বিয়াম মডেল স্কুল ও কলেজের নিশাত তাসনিম, জুনিয়রে রাজশাহীর শহীদ নাজমুল হক বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের খাদিজাতুল কুবরা ও সেকেন্ডারিতে রংপুর জেলা স্কুলের মো. তৈমুর হাসান।
দলভিত্তিক দেয়ালিকা প্রতিযোগিতায় এই তিন বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে নওগাঁর চক্রামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বগুড়ার আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও রংপুর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় দল।