গ্যাস-সংকট

অতিরিক্ত খরচ করেও উৎপাদন–সংকটে শিল্প

বন্ধ হয়ে গেছে একটি এলএনজি টার্মিনাল। এতে গ্যাস সরবরাহ আরও কমেছে। বাড়তি খরচ করে ডিজেল ব্যবহার করা হচ্ছে।

বন্ধ হয়ে গেছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহের একটি টার্মিনাল। এটি পুনরায় চালু হতে ৪৫ দিন সময় লাগতে পারে। এতে এলএনজি সরবরাহ গত সপ্তাহের চেয়ে আরও কমে গেছে। তাই চাহিদা পূরণ করতে পারছে না গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো। রপ্তানিমুখী বড় শিল্পকারখানা ধুঁকছে গ্যাসের অভাবে। বাড়তি দামে বিকল্প জ্বালানি কিনেও চাহিদামতো উৎপাদন ধরে রাখতে পারছে না শিল্প।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন-পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। মোটামুটি ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ পেলে বড় ধরনের অসুবিধা হয় না। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন কমেছে। এর মধ্যে এলএনজি সরবরাহ কমে গেছে। গত মাসের শেষ দিকেও দিনে সরবরাহ ছিল গড়ে ২৬৫ কোটি ঘনফুট। এখন এটি নেমে এসেছে ২৫০ কোটি ঘনফুটে।

গ্যাসের সরবরাহ আসে মূলত দুটি উৎস থেকে। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন ও বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি। বৈদেশিক মুদ্রা ডলার সাশ্রয়ে গত বছর খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করে সরকার। জুলাই থেকে পরবর্তী সাত মাস এটি বন্ধ থাকে। এরপর গত জানুয়ারিতে ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম গড়ে ৮০ শতাংশ বাড়িয়ে ফেব্রুয়ারি থেকে কেনা শুরু হয় আবার। তবে শিল্প খাতে বাড়ানো হয় ১৭৯ শতাংশ। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের শর্তে এটি মেনে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বেশি দাম দিয়েও এখন গ্যাসের অভাবে কারখানা চালানো যাচ্ছে না বলে অভিযোগ তাঁদের।

চাহিদার চেয়ে সরবরাহ ঘাটতি থাকায় সব সময় এক খাত থেকে কমিয়ে অন্য খাতে সরবরাহ বাড়ানো হয়। আর শীত মাথায় রেখেই এলএনজির আমদানি পরিকল্পনা করা হয়। শিগগিরই বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের সরবরাহ আরও কমবে। তখন সরবরাহ নিয়ে এত সমস্যা থাকবে না।
মো. কামরুজ্জামান খান, পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড মাইনস)

আমদানি করা এলএনজি রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহের জন্য মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল আছে। এর মধ্যে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনালটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গত এপ্রিলে বন্ধ হওয়ার কথা ছিল। গ্যাস-সংকট বাড়বে বিবেচনায় এটি পিছিয়ে দেওয়া হয় নভেম্বরে।

এবারও পেছানোর অনুরোধ করা হয়েছিল। তবে তা আর সম্ভব হয়নি। ১ নভেম্বর থেকে টার্মিনালটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দুটি টার্মিনাল মিলে দিনে ৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হতো। এখন শুধু সামিট গ্রুপের ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে ৫০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছে।

পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড মাইনস) মো. কামরুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, চাহিদার চেয়ে সরবরাহ ঘাটতি থাকায় সব সময় এক খাত থেকে কমিয়ে অন্য খাতে সরবরাহ বাড়ানো হয়। আর শীত মাথায় রেখেই এলএনজির আমদানি পরিকল্পনা করা হয়। শিগগিরই বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের সরবরাহ আরও কমবে। তখন সরবরাহ নিয়ে এত সমস্যা থাকবে না।

রি-রোলিং কারখানায় গ্যাসের দরকার বেশি। তবে গ্যাসের চাপ কম থাকায় ফার্নেস তেল ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়ছে।
তপন সেনগুপ্ত, ইস্পাত খাতের প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক

চাপে আছে ভারী শিল্পকারখানা

ভারী শিল্পকারখানার সিংহভাগ চট্টগ্রামে। ইস্পাত, কাচ, সিমেন্টসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানায় উৎপাদন সচল রাখার জন্য গ্যাসের দরকার হয়। তবে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উদ্যোক্তাদের। তাঁরা বলছেন, গ্যাসের চাপ কম পাচ্ছেন তাঁরা।

ইস্পাত খাতের প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, রি-রোলিং কারখানায় গ্যাসের দরকার বেশি। তবে গ্যাসের চাপ কম থাকায় ফার্নেস তেল ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়ছে।

তবে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শিল্পে গ্যাসের তেমন কোনো সংকট নেই। চট্টগ্রামে সার কারখানা ছাড়া শিল্পে গ্যাসের চাহিদা দিনে সাড়ে ছয় কোটি ঘনফুট। সোমবার শিল্পে পাঁচ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে।

বাড়তি দাম নিয়েও শিল্পে গ্যাস দিতে পারছে না তিতাস। গ্যাস-সংকটের দ্রুত সমাধান না হলে শ্রমিকের নতুন ঘোষিত মজুরি দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে এবং শিল্প টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। ২০৩০ সাল নাগাদ ১০০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির স্বপ্নও বিলীন হয়ে যাবে।
মোহাম্মদ হাতেম, বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি

ডিজেল দিয়ে কারখানা সচল রাখার চেষ্টা

গাজীপুর-ঢাকা সড়কের পাশেই তিন সড়ক এলাকায় অবস্থিত স্প্যারো অ্যাপারেলস লিমিটেড নামের পোশাক কারখানা। ওই কারখানার পরিচালক কাজী শরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত গ্যাসের চাপ যা থাকে, তা দিয়ে কারখানা চালানো যায় না।

ডিজেল দিয়ে জেনারেটর চালাতে হয়। এতে খরচও বেড়ে যাচ্ছে। কোনাবাড়ী এলাকার এটিএস ফ্যাশন লিমিটেড কারখানার উৎপাদন কর্মকর্তা হামিদুর রহমান জানান, বারবার গ্যাসের চাপ বাড়ানোর দাবি জানিয়েও তিতাস থেকে সুরাহা পাচ্ছেন না। উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটায় বেশ ক্ষতির মুখে রয়েছেন তাঁরা।

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার নয়ামাটি এলাকায় অবস্থিত রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান আইএফএস নিটওয়্যার লিমিটেডের দিনে উৎপাদন ক্ষমতা ২২ টন। গ্যাস-সংকটের কারণে উৎপাদন দুই থেকে তিন টনে নেমে গেছে। শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ ও ব্যাংকঋণ পরিশোধে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে দাবি করেন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালাউদ্দিন আহমেদ।

চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় গ্যাসের এই সংকট তৈরি হয়েছে বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন তিতাস গ্যাস নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপমহাব্যবস্থাপক মামুনুর রশিদ।

পোশাক রপ্তানি নিয়ে দুশ্চিন্তা

পেট্রোবাংলা বলছে, নভেম্বরে এলএনজি সরবরাহ কমলেও গ্যাসের সংকট হয় না সাধারণত। গত বছর এ সময়ে এলএনজি থেকে দিনে সরবরাহ করা হয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ কোটি ঘনফুট। এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ৫০ কোটি ঘনফুট। গত বছরের চেয়ে এবার দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে ১৫ কোটি ঘনফুটের মতো উৎপাদন কমে গেছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে গত বছর সরবরাহ করা হয়েছে ৮০ কোটি ঘনফুট। এখন দেওয়া হচ্ছে ৯০ কোটি ঘনফুট। তাই এ বছর শিল্পের চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না।

বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, বাড়তি দাম নিয়েও শিল্পে গ্যাস দিতে পারছে না তিতাস। গ্যাস-সংকটের দ্রুত সমাধান না হলে শ্রমিকের নতুন ঘোষিত মজুরি দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে এবং শিল্প টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। ২০৩০ সাল নাগাদ ১০০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির স্বপ্নও বিলীন হয়ে যাবে।

[প্রতিবেদনে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম, গাজীপুরপ্রতিনিধি, নারায়ণগঞ্জ]