স্বাস্থ্যসেবায় ভাসমান এক জীবনতরি

ভাসমান সেই হাসপাতাল। পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন রোগীরা
ছবি: প্রথম আলো

স্ত্রী আফরোজা আক্তারের কাঁধে ভর দিয়ে বগুড়ার দেবভাঙ্গা এলাকায় যমুনা নদীর পাড় দিয়ে হাঁটছিলেন ষাটোর্ধ্ব আয়নাল হক। আগের দিনই সেখানকার একটি হাসপাতালে চোখে ছানিজনিত অস্ত্রোপচার হয়েছে তাঁর। ট্রলারে করে সিরাজগঞ্জের নাটোয়ারপাড় এলাকার বাড়িতে ফিরবেন আয়নাল। গায়ে কমলা রঙের সোয়েটার আর চাদর। মাথা থেকে কান পর্যন্ত মাফলার দিয়ে মোড়ানো। চোখে কালো রঙের চশমা। মুঠোফোনে ছবি তুলতেই আয়নালের মুখে চওড়া হাসি।

এত আনন্দের কারণটাও জানালেন আয়নাল। তিনি বলেন, এক বছর আগে তাঁর ডান চোখ ছানিতে ঢেকে যায়। বাঁ চোখেও কম দেখেন। তবে আগের দিন তাঁর চোখের ছানির অস্ত্রোপচার হয়েছে। সকালে (২৪ জানুয়ারি) ব্যান্ডেজ খোলার পর থেকে তিনি আবার ডান চোখে দেখতে পাচ্ছেন।

যে হাসপাতালে আয়নালের চোখের অস্ত্রোপচার হয়েছে, সেটি ব্যতিক্রমধর্মী। হাসপাতালটি ভাসমান একটি জাহাজের ওপর নির্মিত। আর এতে চিকিৎসা মেলে বিনা মূল্যে। বলা যায়, এটি একটি ভাসমান জীবনতরি। এ জীবনতরির নাম ‘লাইফবয় ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল’। চালুর পর থেকে এর চিকিৎসক ও নার্সরা আয়নালদের মতো চরবাসী ও নদীতীরের দরিদ্র মানুষদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে লাখো হৃদয়ছোঁয়া ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন।

চিকিৎসা শেষে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়েছেন আয়নাল আর আফরোজা

ডান চোখের দৃষ্টি ফিরে পাওয়ায় আনন্দ প্রকাশ করে আয়নাল বলেন, ‘ছানি কাটছে। সকালে ওষুধপত্ত দিছে। এইরম সেবার বদলে কিছুই দিবার পারুম না। তাই হাত ভইরা দোয়া দিলাম।’

তাঁর চার ছেলের আলাদা সংসার। দিনমজুরির পাশাপাশি গরু-ছাগল লালন-পালন করেন স্ত্রী। চোখের সমস্যার কারণে আয়নাল এত দিন নিজে কোনো কাজ করতে পারতেন না। তবে এবার থেকে অন্তত গবাদিপশু পালনে স্ত্রীকে সহায়তা করতে পারবেন বলে আশা তাঁর।

চরবাসী ও নদীপারের মানুষের কাছে ‘লাইফবয় ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল’ ‘নাইবল’ বা ‘লাইবয়’ হাসপাতাল নামেই বেশি পরিচিত। দুই দশক আগে ২০০৩ সালে ইউনিলিভারের পণ্য লাইফবয় ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ফ্রেন্ডশিপের সঙ্গে অংশীদারত্বে এ হাসপাতালের ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু। এখন পর্যন্ত হাসপাতালটিতে ৬ লাখ ৫৭ হাজার ১৮২ রোগীকে ৫ লাখ ২৬ হাজার ৪৪১টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং ৪ লাখ ৬৫ হাজার ৩৪৯টি মাধ্যমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়েছে।

দেশের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চল বা দুর্গম চরের মানুষেরা প্রতিকূল প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই-সংগ্রাম করেন। কখনো কখনো ঝড়-তুফান, নদীভাঙন বা বন্যা তাদের ঘরবাড়ি, ফসল ও গবাদিপশু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বেঁচে থাকাই যেখানে এক সংগ্রাম, সেখানে স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবার ফুরসত মেলে না তাদের। চরবাসীর কারও জীবিকা মাছ ধরা, কৃষিকাজ করা কিংবা দিনমজুর খাটা। চিকিৎসার জন্য তাঁরা হাটবাজারের ওষুধের দোকানদারের ওপর নির্ভর করে থাকেন। তাই চরাঞ্চলের হতদরিদ্র ও নদীভাঙনকবলিত মানুষের কাছে হাসপাতালটি যেন দুঃসময়ে সেবা দেওয়ার বন্ধু।

অস্থায়ী টিনের তৈরি ওয়ার্ড কক্ষে নারী ও পুরুষ রোগীরা

হাসপাতালটির কার্যক্রম দেখতে ২৪ জানুয়ারি সরেজমিনে গিয়েছিলেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। ভাসমান হাসপাতালটি তখন বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার দেবভাঙ্গা এলাকায় যমুনা নদীতে ছিল।

সরেজমিনে দেখা যায়, নদীপাড়ের খোলা জায়গায় টিনের বেড়া আর ছাউনি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে নারী ও পুরুষদের থাকার পৃথক দুটি ঘর। অস্ত্রোপচারের রোগীরা প্রয়োজন অনুযায়ী কয়েক দিন সেখানে থাকেন। আছে রান্নাঘর এবং দোচালা একটি ঘরে রোগীদের অপেক্ষার কেন্দ্র।

পাড়ে ভেড়ানো জাহাজের ভেতরে নিচের ডেকে থাকেন চিকিৎসক ও কর্মীরা। ওপরের ডেকে দুটি অস্ত্রোপচার কক্ষ, গাইনোকলজি বিভাগ, চক্ষু বিভাগ, প্যাথলজিক্যাল ল্যাব, ডিজিটাল এক্স-রে কক্ষ ও ফার্মেসি। সঙ্গে প্রত্যন্ত চর থেকে রোগী আনতে দুটি নৌ অ্যাম্বুলেন্স ও রোগীদের পৌঁছে দেওয়ার জন্য দুটি ট্রলার রয়েছে।

ফ্রেন্ডশিপের উপপরিচালক (স্বাস্থ্য) চিকিৎসক রাফি আবুল হাসনাত সিদ্দীক বলেন, হাসপাতালে বিনা মূল্যে প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যা, মাতৃত্বজনিত সেবা, শিশুস্বাস্থ্য পরিচর্যা, দাঁতের চিকিৎসা, অস্ত্রোপচার, এক্স-রে, ইসিজিসহ সব ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করা হয়। এ ছাড়া ঠোঁটকাটা ও তালুকাটা, পোড়া রোগী, হাত-পা বাঁকা (অর্থোপেডিক সার্জারি), হার্নিয়া, হাইড্রোসিল, টিউমার ও চোখের ছানির অস্ত্রোপচারও করা হয়। বিভিন্ন দেশ থেকে আসেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালটি কয়েক মাস পরপর সেবা দেওয়ার স্থান পরিবর্তন করে। গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর ও বগুড়া জেলার প্রায় ১২০ কিলোমিটার নদীপথের নতুন কোনো এলাকায় নোঙর করে। এসব এলাকার অর্ধশতাধিক চরাঞ্চলের হতদরিদ্র ও নদীভাঙনকবলিত মানুষকে সেবা দেয়।

হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে

প্রতিবেদকের সেদিন পৌঁছাতে বিকেল হয়ে যাওয়ায় সেখানে রোগীর তেমন ভিড় ছিল না। হাসপাতালে শুধু চোখের ছানির রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা ছিলেন। এ ছাড়া বহির্বিভাগের কিছু রোগী ছিলেন। দানেস ফকির নামের এমন এক ব্যক্তি জাহাজে চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছিলেন। বয়স ৮০ ছুঁয়েছে বলে জানালেন নিজেই। বাড়ি সিরাজগঞ্জের চরপানাগারিতে।

দানেস ফকির বলেন, ‘আত-পাওয়ে বল পাই না। হাটবার গেলেই পইড়া যাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘কষ্ট কইরা এইহানে আইছি, ভালা ডাক্তর দেহাইত। এহানে ভালা ওষুধ দেয়।’

দানেসের অসুখের বিষয়ে চিকিৎসক সাজিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নিম্ন রক্তচাপের কারণে তিনি মাঝেমধ্যেই দুর্বল হয়ে যান। এ জন্য তাঁকে এক মাসের ওষুধ দেওয়া হয়েছে।

হাসপাতালের অস্ত্রোপচার–পরবর্তী পর্যবেক্ষণকক্ষে রোগীদের দেখভাল করছিলেন নার্স শিল্পী শিকদার। হাসপাতালটিতে ছয় বছর ধরে কাজ করছেন তিনি। চিকিৎসার জন্য আসা অনেক রোগী ও স্বজনেরা এখন তাঁকে চেনেন, নাম ধরে খোঁজেন।

শিল্পী শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেককে দেখেছি হাত তুলে প্রাণভরে দোয়া করতে। কেউ কেউ মাথায়ও হাত বুলিয়ে দিয়ে যায়। তখন খুব ভালো লাগে।’ জাহাজ থেকে নেমে নদীর পাড়ে নারী রোগীদের থাকার ঘরে কথা হয় জামালপুরের মাদারগঞ্জের অবিরন বেগমের সঙ্গে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুখে ভুগছিলেন।

জাহাজ হাসপাতাল থেকে রোগীদের ওয়ার্ডে নেওয়া হচ্ছে

মাঝেমধ্যে অসুখ বাড়লে বাজারে ওষুধের দোকানই ছিল ভরসা। তাতে রোগ সারছিল না। একদিন এ হাসপাতালের বিষয়ে জানতে পারেন। অবিরনের জরায়ুতে অস্ত্রোপচার হয়েছে।

অবিরনের সঙ্গে আসা নাতবউ রিনা সুলতানা বলেন, ‘আমগো অবস্থা গরিব। জমিজিরাত কিছু নাইকা। বর্গা চাষ করে খাই। ডাক্তর কাছে যাইবার টেহা পামু কই?’

পরদিন সকালে আবারও ব্যতিক্রমধর্মী ওই হাসপাতালে যান এই প্রতিবেদক। এদিন সেখানকার অপেক্ষা কক্ষে থাকা পাঁচ নারী রোগীর সঙ্গে কথা হয়।

বগুড়ার চাপড়া এলাকার এই নারীরা হলেন মাজেদা খাতুন, সাজেদা বেগম, হাজেরা খাতুন এবং দুই বোন তারাবানু ও চন্দ্রাবানু। ওই পাঁচ নারীর টোকেনের ক্রমিক নম্বর ছিল যথাক্রমে ৩২, ৩৪, ৩৫, ৩৬ ও ৩৭। কথা বলে জানা যায়, রাতে খাওয়ার পর তাঁরা কেউ আর ঘুমাননি। রাত দুটার দিকে ব্যাটারিচালিত অটো ভ্যানে করে রওনা হন। পথে কনকনে ঠান্ডায় একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ছিলেন। ভোরে দেবভাঙ্গা বাজারে এসে পৌঁছান।

মাজেদা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ভোরে ভ্যান থেকে নামার পর তাঁরা শীতে কাঁপছিলেন। ঠিকমতো হাঁটতে পারছিলেন না। মাজেদা খাতুন আরও বলেন, ‘নদীর পাড়ে বাত্তি দেইখা হাঁইটা আসি। রাস্তা উঁচুনিচু হওয়ায় কয়েকবার আছাড় খাইছি।’

সিরিয়ালে ৩৬ নম্বরে ছিলেন হাজেরা খাতুন। তিনি বলেন, ‘আমগো তো টেকাপয়সা নাই। কেমনে ওষুধ খামু? গরিবের তো চিহিৎসাও নাই।’ ইউনিলিভার বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জাভেদ আখতার হাসপাতালটি নিয়ে বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য সবার জন্য টেকসই জীবন নিশ্চিত করা।

এ লক্ষ্যে লাইফবয় মানুষের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।’
প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার চ্যালেঞ্জ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, লাইফবয় ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল চরাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছে। ইউনিলিভার বাংলাদেশ এভাবেই আজীবন বিপন্ন মানুষের পাশে থাকতে চায়।

বহির্বিভাগে নিয়মিত সেবা দেওয়ার পাশাপাশি এ হাসপাতালে ২৩০টি জাতীয় ও ১৮৬টি আন্তর্জাতিক মেডিকেল টিম ৪১৬টি বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা ক্যাম্প পরিচালনা করেছেন। ১৬ হাজার ৩৮৫টি অস্ত্রোপচার হয়েছে। বিশেষায়িত পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ৪২ হাজার ৯৩১টি। এ ছাড়া চোখের ৯ হাজার ৮১১টি, দাঁতের ৩ হাজার ২১৮টি অস্ত্রোপচারের পাশাপাশি ৭৬৫টি অর্থোপেডিক, ৬৭৩টি পেডিয়াট্রিক এবং ৬৪৯টি রিকনস্ট্রাকটিভ অস্ত্রোপচার হয়েছে।