‘আমি শুধু মাকে খুঁজেছি। খুঁজতে গিয়ে যা যা ভুল হয়েছে, তার জন্য মাফ চাই। অনেকের মন্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, ফুলপুরের লাশটা আমার মায়ের হলেই তাঁরা খুশি হতেন।’ প্রায় এক মাস ধরে মায়ের সন্ধান চেয়ে সভা–সমাবেশ করে আসা মরিয়ম মান্নান তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের জবাবে এ কথা বলেছেন। আজ মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর একটি হাসপাতালে মা রহিমা বেগমকে চিকিৎসক দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন মরিয়ম মান্নান। সেখানে তাঁর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর।
মরিয়ম মান্নান বলেন, ‘মা আত্মগোপনে গিয়ে থাকলে তাঁকে খোঁজা আমার ঠিক হয়নি। তবে তার আগে প্রমাণ হতে হবে, মা আত্মগোপনে গিয়েছিলেন নাকি অপহরণের শিকার হয়েছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাকে নিয়ে যেভাবে ট্রল করা হচ্ছে, তাতে আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। আমার পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ তিনি জানান, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্ত যথাযথভাবে হলে তাঁদের পক্ষেই সত্য প্রকাশ পাবে।
তাঁর মা অপহৃত হয়েছেন বলে যে দাবি করা হয়েছিল, সে বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে মরিয়ম বলেন, ‘মায়ের কথা শুনে মনে হয়েছে অপহরণ। তবে আমি এখনও সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি।’
গত ২৮ আগস্ট রহিমা বেগমের আরেক মেয়ে আদুরী আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে খুলনার দৌলতপুর থানায় মাকে অপহরণের অভিযোগ তুলে মামলা করেন। পরিবারটির অভিযোগ ছিল, গত ২৭ আগস্ট রাত ১০টার দিকে দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকার বাসার উঠানের নলকূপ থেকে পানি আনতে গিয়ে আর বাড়ি ফেরেননি রহিমা বেগম। ওই রাতেই রহিমা বেগমের ছেলে দৌলতপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। রহিমা বেগমের ছেলে–মেয়েরা মায়ের সন্ধান চেয়ে এলাকায় পোস্টার লাগানো, ঢাকা ও খুলনায় মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন করেন। মেয়ে মরিয়ম মান্নান ফেসবুকে মায়ের সন্ধান চেয়ে বিভিন্ন পোস্ট দেন। ঘটনাটি ফেসবুকে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশ হয়। মায়ের সন্ধান দাবিতে আয়োজিত এক কর্মসূচিতে মরিয়ম মান্নানের কান্নার ছবি দেখে তাঁর পক্ষে সোচ্চার হয়েছিলেন অনেকে।
এর মধ্যে গত ২২ সেপ্টেম্বর এক ফেসবুক পোস্টে ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার বওলা গ্রামের ঝোপ থেকে উদ্ধার হওয়া এক নারীর লাশকে নিজের মায়ের বলে দাবি করেন মরিয়ম মান্নান। পরদিন ফুলপুরে গিয়ে লাশটি মায়ের বলে শনাক্ত করেন। এ ঘটনায় মরিয়ম মান্নানের পক্ষে ফেসবুকে সরব হয়েছিলেন বহু মানুষ। তবে ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে ফরিদপুরের বোয়ালমারীর একটি বাসা থেকে মরিয়মের মা রহিমা বেগমকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। এরপর মরিয়ম মান্নানের প্রতি সহানুভূতি জানানো ব্যক্তিদের একটি অংশ তাঁদের ‘আবেগ নিয়ে খেলা হয়েছে’ উল্লেখ করে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দিতে শুরু করেন।
মরিয়ম মান্নানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সমালোচনা হচ্ছে যে পুরো ঘটনাটা সাজানো, আপনার মা আত্মগোপনে ছিলেন, আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল—এ বিষয়ে আপনার ব্যাখ্যা কী? জবাবে এই তরুণী বলেন, ‘আমরা কিছুই সাজাইনি। মায়ের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। যাঁরা বলছেন, তাঁরা প্রমাণ করুন যে মা আত্মগোপনে ছিলেন। যে বাড়ি থেকে মাকে উদ্ধার করা হয়েছে, তারও ১৭ দিন আগে মা কোথায় ছিলেন, সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাইনি। মায়ের কাছ থেকে যতটুকু শুনেছি, তাতে বুঝতে পারছি তিনি অপহরণের শিকার হয়েছিলেন। যে বাড়িতে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁরা আমাদের পরিচিত। তাঁরা তবে কেন আমাদের সঙ্গে মায়ের কথা জানিয়ে যোগাযোগ করলেন না?’
ওই বাড়ির একজন আপনার ফেসবুকে কমেন্ট করেছিলেন এবং আপনার ভাবিকে ফোন দিয়েছিলেন বলে পুলিশকে জানিয়েছেন। এ বিষয়ে মরিয়ম বলেন, ‘তাঁরা যোগাযোগ করেছিলেন ফুলপুরে মা ভেবে একজনের লাশ শনাক্ত করে ফেরার পথে। এর আগে অসংখ্যবার আমাদের কাছে ভুয়া ফোন এসেছে। ভাবিকে তাঁরা মায়ের কথা না জানিয়ে বলছিলেন, আপনার স্বামীকে (মরিয়মের ভাই) ফোন দেন। ভাবি বলেছিলেন আমাকেই বলেন। ওই লোক কিছু না বলে রাগারাগি করলে ভাবি ফোন রেখে দেন। ফেসবুকে কমেন্ট করেছিলেন, এটা আমার জানা নেই।’
লাশটিকে আপনার মায়ের মনে হলো কেন? তা ছাড়া এ বিষয়ে আপনার ফেসবুক পোস্ট আরও বিভ্রান্তি তৈরি করেছে বলে কি মনে করছেন না? জবাবে মরিয়ম বললেন, ‘এত দিন মাকে খুঁজে না পেয়ে আমরা বিপর্যস্ত ছিলাম। অনেকে বলা শুরু করেছিলেন, মা বেঁচে নেই। অনেক জায়গায় গেছি। মর্গে মর্গে গেছি। পচাগলা লাশের ছবি দেখে মায়ের মতো মনে হয়েছিল। লাশটি আগেই দাফন করা হয়েছিল। আমরা লাশ দেখিনি। আমরা ডিএনএ পরীক্ষার জন্যও আবেদন করেছিলাম।’
নিশ্চিত না হয়ে লাশটিকে মায়ের বলে দাবি করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা শনাক্ত করতে গিয়ে ভুল করেছি। ওখানে অন্যরা যে বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে আমরা ভাই–বোনেরা মনে করেছি, এটা মা–ই হবেন।’ সেখানে পুলিশ যে পোশাক দেখিয়েছিল, সেটি আপনার মায়ের ছিল না। এ বিষয়ে মরিয়ম মান্নান বলেন, ‘দেখুন, এই ক্ষেত্রে আমাদের ভুল হয়েছে, কারণ আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলাম। আপনাদের মা এত দিন নিখোঁজ থাকলে কেমন লাগত, একবার চিন্তা করে দেখুন। তবে লাশটি নিয়ে অনেকের মন্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, লাশটি আমার মায়ের হলে তাঁরা খুশি হতেন। ওই লাশটি কার, সেটা কেউ খোঁজার চেষ্টা করছেন না কেন?’
আপনাদের মামলায় প্রতিবেশীরা কারাগারে ছিলেন। তাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন যে দোষ না করেও তাঁদের জেল খাটতে হলো। এ বিষয়ে মরিয়ম মান্নান বলেন, ‘আমার সৎ ভাইয়েরা তাঁদের অংশ বিক্রি করে দিয়েছিলেন প্রতিবেশীর কাছে। শরিক হিসেবে বিষয়টি সুরাহার জন্য মা মামলা করেছিলেন। ওই মামলার জেরে ওই প্রতিবেশীরা মায়ের ওপর হামলা করেছিলেন। সেটি নিয়ে মামলা চলছিল। ওদের কারণে প্রায় এক বছর ধরে নিজের বাড়ি ছেড়ে মা ভাড়া বাসায় থাকতেন। মাঝে মাঝে নিজের বাড়িতে আসতেন। ঘটনার আগের দিন তিনি এসেছিলেন। পরদিন নিখোঁজ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আমরা ওই প্রতিবেশীদের সন্দেহ করেছি।’
আপনার মা ফরিদপুরে এক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছিলেন নতুন জন্মনিবন্ধন করার জন্য। কেন নতুন জন্মনিবন্ধন করতে চেয়েছিলেন তিনি, এ নিয়ে কি কিছু বলেছেন—এ প্রশ্নের জবাবে মরিয়ম মান্নান বলেন, ‘মাকে চাপ দিয়ে কিছু জানতে চাইনি। তিনি অনেক অসুস্থ। আমার নিজেরও অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি। পিবিআই তদন্ত করছে। আমরা তদন্ত প্রতিবেদন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাই। তদন্ত যথাযথ হলে আপনারাও অনেক সত্য জানতে পারবেন। প্রকৃত তদন্ত হলে আমরা যে সত্য বলছি, সেটাই প্রমাণ হবে।’
মায়ের সঙ্গে আপনাদের ভাই–বোনের সম্পর্ক ভালো না, এমনটাও বলা হচ্ছে। এ বিষয়ে কিছু বলবেন কি? মরিয়মের জবাব, ‘এটা একদম মিথ্যা কথা। মায়ের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুব ভালো। মাস দুয়েক আগেও মা ঢাকায় আমার বাসায় বেড়িয়ে গেছেন। মাকে উদ্ধারের পর গণমাধ্যমে অনেক কথাই এসেছে, যা মা বলেননি। মা পুলিশকে শুধু বারবারই বলেছেন, তিনি ছেলে–মেয়েদের দেখতে চান। তিনি আমাদের দেখে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন। এ মুহূর্তে মায়ের সুস্থতাই আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মাকে ফিরে পেয়েছি, আর কিছু চাই না।’
হাসপাতালে চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষার সময়ে যখন মরিয়ম মান্নান প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলছিলেন, পুরোটা সময় কাছেই একটি চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছিলেন রহিমা বেগম। মরিয়ম জানিয়েছেন, তিনি এখন আর ফেসবুকে ঢুকতে পারছেন না।