সাত মাস বয়সী মেয়ে জান্নাতকে নিয়ে আহ্লাদের যেন শেষ ছিল না বাবা আবদুল আউয়ালের। চট্টগ্রামের ষোলশহর রেলস্টেশনের চা-দোকান করে সংসার চালাতেন। ব্যস্ত জায়গাটায় সারা দিন ‘কাস্টমারের’ ভিড়। দোকান খুলতে হতো ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে। আর কর্মব্যস্ততা শুরুর সেই সময়টায়ও আউয়াল জান্নাতকে নিয়ে হাজির হতেন দোকানে। মেয়েকে দোকানে বসিয়ে চায়ের সরঞ্জাম সাজাতেন, চুলা জ্বালাতেন। এলাকার লোকজনও জানতেন, ‘কলিজার টুকরা’ মেয়েটাকে বাবা কখনো চোখের আড়াল করতে চাইতেন না। আর শেষ যাত্রায়ও মেয়েটাই সঙ্গী হলো তাঁর।
আজ রোববার সকাল সাতটায় চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর রেলস্টেশন–সংলগ্ন আইডব্লিউ কলোনিতে পাহাড় ধসে মাটিচাপা পড়ে মৃত্যু হয় আবদুল আউয়াল (৩৫) ও তাঁর মেয়ে জান্নাতের। প্রতিদিন ভোরে মেয়েকে নিয়ে দোকানে চলে গেলেও আজ এই রুটিনের ব্যতিক্রম হয়েছিল। বিরামহীন বৃষ্টির কারণে দোকান খোলেননি আউয়াল, ঘুমিয়েছিলেন মেয়েকে নিয়ে। আর সেই ঘুমই হয়ে উঠল শেষ ঘুম।
ষোলশহর রেলস্টেশনের পেছনে আইডব্লিউ কলোনিতে পাহাড়ের ঠিক নিচেই ছিল আবদুল আউয়ালের টিনের ভাড়া ঘর। সেখানে দুই মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে থাকতেন তিনি। আজ সকাল নয়টায় সেখানে গিয়ে যেন এক ধ্বংসযজ্ঞই দেখা গেল। পাহাড়ের ওপর থেকে স্রোতের মতো মাটি আর ইটের টুকরা ভেঙে আছড়ে পড়েছে টিনের ঘরটির ওপর। মাটিচাপা পড়া বিধ্বস্ত ঘরটির মুখে ছড়িয়ে ছড়িয়ে আছে আছে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-পাতিল আর ভাঙা টিন। সংসারটা আর নেই। কেবল তার কিছু চিহ্ন পড়ে আছে এদিক-ওদিক।
ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িটির পাশের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন জান্নাতে মা শরীফা বেগম ও তাঁর ১২ বছর বয়সী মেয়ে বিবি কুলসুম। ঘটনার সময় একই বিছানায় ঘুমিয়েছিল তাঁরা চারজন। প্রবল বৃষ্টির সময় হঠাৎ বোমা ফাটার মতো তীব্র শব্দ পেয়ে দ্রুত বেরিয়ে আসেন শরীফা ও তাঁর মেয়ে। এরপরই মুহূর্তে মাটিচাপা পড়ে ঘরটি। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠে শরীফা বুঝতে পারেন, ভেতরে তাঁর স্বামী আর মেয়ে রয়ে গেছে। তাঁর তীব্র চিৎকারে পাড়া–প্রতিবেশী ছুটে আসেন। একসময় আসে ফায়ার সার্ভিসের লোকজনও। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।
বাড়ি থেকে বের হতে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন শরীফা। তবে আরও অনেক বড় আঘাত সেই ব্যথার অনুভূতি নষ্ট করে দিয়েছিল। স্বামী আর মেয়ের এমন মৃত্যুতে হতবিহ্বল শরীফা বেগম বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। জ্ঞান ফিরতেই শুরু করছিলেন আহাজারি। ‘আল্লারে, বাপ-ঝি (কন্যা) দুজনরে লই গেলা। আই অন কারে লই বাঁচমু? আই কিল্লাই মরি ন!’ সান্ত্বনা দিতে আসা প্রতিবেশী ও স্বজনদেরও চোখে জল। কী বলে সান্ত্বনা দেবেন তাঁরা, কোনো ভাষাই নেই কারও মুখে।
আবদুল আউয়াল ও শরীফা দম্পতির বাড়ি ফেনী জেলায়। বহু বছর ধরে চট্টগ্রামেই তাঁদের স্থায়ী নিবাস। সংসারের অভাব-অভিযোগ থাকলেও সুখের কমতি ছিল না। পরিশ্রম করে সংসারটাকে দাঁড় করাচ্ছিলেন তাঁরা।
কান্নার দমকে কথা বলতে পারছিলেন না শরীফা। তবু বিলাপের সুরে সুরে স্বামীর আর প্রিয় কন্যার কথাই বলে যাচ্ছিলেন। এমন বিপর্যয়ের জন্য বৃষ্টিকে নয়, এলাকার প্রতাপশালী এক লোককে দায়ী করলেন তিনি। তাঁর নাম আবদুল খালেক। চাকরি করেন রেলওয়ের খালাসি পদে। খালাসি হলেও খালেকের কথাই এই এলাকার আইন। আউয়ালের বাসার পাশ ঘেঁষে পাহাড় কেটে তিনি ঘর তুলে ভাড়া দিয়েছিলেন। পাহাড় কাটার সময় আউয়াল প্রতিবাদ করলেও কোনো কাজ হয়নি। খালেককে কেউ দমাতে পারেনি। উল্টো হুমকি দিতেন তিনি। বলতেন, পুলিশ আর প্রশাসন তাঁর পকেটে থাকে। তবে পাহাড়ধসের ঘটনার পর থেকেই পলাতক রয়েছেন খালেক।
রেলওয়ের খালাসি আবদুল খালেক আট বছর আগে আইডব্লিউ কলোনিতে আসেন বলে জানান এলাকার বাসিন্দারা। তিনি সেখানে পরিবার নিয়ে একটি বাসায় থাকেন। চার-পাঁচ বছর ধরে পাহাড় কেটে ঘর তৈরি করছিলেন তিনি। ইতিমধ্যে পাহাড় কেটে এক শটির মতো ঘর তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন। টিনের ঘরগুলো থেকে মাসে দেড় থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া তুলতেন খালেক। তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে বিভিন্নভাবে হয়রানি করতেন। ঘটনার পর থেকে পরিবার নিয়ে পালিয়ে গেছেন তিনি।
ষোলশহরের পাহাড়ে যে অবৈধ বসতি গড়ে উঠেছিল, তা স্বীকার করলেন রেলওয়ের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক আবিদুর রহমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত থাকলে আবদুল খালেকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আগে কেউ জমা দিয়েছেন কি না, তা খোঁজ নিয়ে দেখবেন।
ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানালেন চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমাও। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, পাহাড় কাটার পর সেখানে ইটের দেয়াল দেওয়া হয়েছিল। বৃষ্টিতে পাহাড় আর দেয়াল ধসে পড়ে বাবা-মেয়ে দুজন মারা গেছেন। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আইডব্লিউ কলোনি ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল জান্নাতের মা শরীফার বিলাপ। ২০-২৫ বছর বয়সের এই নারীর পুরো জীবনটাই পড়ে আছে সামনে। তবু পাহাড়ধসের মাটি তার জন্য যা রেখে গেছে, তার আক্ষরিক নাম দুঃস্বপ্ন ছাড়া অন্য কিছু নয়। শরীফা জানেন, যত দিন বেঁচে থাকবেন, তাঁকে বয়ে বেড়াতে হবে এই দুঃস্বপ্নের ভার।