ট্রেনের মাইকে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল, গ বগিতে একজন যাত্রী গুরুতর অসুস্থ, ট্রেনে কোনো চিকিৎসক থেকে থাকলে তিনি যাতে সহায়তা করেন। ট্রেনটির ড বগির ১০৫ নম্বর আসনের যাত্রী ছিলেন চিকিৎসক আহসান হাবিব। ঘোষণা শুনে তিনি গ বগিতে গেলেন। রোগী প্রায় অচেতন অবস্থায় আছেন। আহসান হাবিব ট্রেনের পরিচালকের কাছে ডায়াবেটিস বা প্রেশার মাপার যন্ত্র চান। ট্রেনে তা ছিল না। প্রাথমিক জরুরি ওষুধের বাক্স পর্যন্ত নেই। এদিকে রোগীর শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। হৃদ্যন্ত্রের সমস্যার রোগীকে বাঁচাতে অতি জরুরি সিপিআর (কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন) দেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নেওয়ার সময় এই চিকিৎসককে একজন যাত্রী তাঁর কাছে থাকা জীবন বাঁচানোর কিছু ওষুধ দিয়ে সহায়তা করেন।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে চিকিৎসক আহসান হাবিব জানালেন, ওই রোগী আবু সায়াদ চৌধুরী আগের চেয়ে ভালো আছেন। হাসপাতালের বিছানায় বসা রোগীর ছবিও পাঠালেন তিনি। গতকাল সোমবার দিনাজপুর থেকে ঢাকাগামী ডাউন দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনে এই ঘটনা ঘটে। ট্রেনটি টাঙ্গাইলে আসার পর ট্রেনের মাইকে ঘোষণাটি দেওয়া হয়েছিল।
রোগী আবু সায়াদ চৌধুরীর (৪০) গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার গোপালপুরে। চিকিৎসক আহসান হাবিবের বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। সোমবার আবু সায়াদ তাঁর পরিবার নিয়ে ঢাকায় ফিরছিলেন। আর আহসান হাবিব সিরাজগঞ্জ সিভিল সার্জন অফিস থেকে প্রশিক্ষণ শেষে ঢাকায় ফিরছিলেন।
ট্রেনের এই অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে এই চিকিৎসক ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। তার পর থেকেই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাঁকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন।
ডা. আহসান হাবিব উজিরের সঙ্গে আজ দুপুরে মুঠোফোনে কথা হয়। তখন তিনি রোগীর অবস্থা জানতে তাঁর সঙ্গে হাসপাতালেই ছিলেন। আহসান হাবিব প্রথম আলোকে জানান, রোগীকে ট্রেনের মধ্যে যতটুকু সম্ভব প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ট্রেনের পরিচালককে ট্রেনটি মির্জাপুর স্টেশনে (অনির্ধারিত বিরতি) থামাতে বলেন। আর নিজের মা হেলেনা আক্তারকে রিকশা নিয়ে স্টেশনে থাকতে বলেন।
আহসান হাবিব বলেন, ‘স্টেশনে নেমে দেখি, আমার মা প্রেশার মাপার যন্ত্র নিয়ে এসেছেন। আমরা দ্রুত রোগীকে কুমুদিনী ওমেনস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করি। হাসপাতালে নেওয়ার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখি, রোগীর হাইট্রপোনিনআই; অর্থাৎ তিনি তখন হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন।’
চিকিৎসক আহসান হাবিবের মুঠোফোনেই কথা হয় রোগী আবু সায়াদ চৌধুরীর স্ত্রী কাশফিয়া বেগমের সঙ্গে। তিনি জানালেন, তাঁর স্বামী একজন নাট্যপরিচালক। তিনি ঢাকায় থাকেন। গত বছর এমবিএ পাস করা কাশফিয়া ৯ বছর বয়সী ছেলে ও ৫ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে দিনাজপুরে থাকেন। আবু সায়াদ চৌধুরী স্ত্রী ও সন্তানদের ঢাকায় আনতে বাড়িতে গিয়েছিলেন।
চিকিৎসক আহসান হাবিবের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে কাশফিয়া বেগম বলেন, এই চিকিৎসক ট্রেনে উপস্থিত না থাকলে বা সহায়তার জন্য এগিয়ে না এলে তাঁদের বড় বিপদ হতো। ছোট ছোট দুই বাচ্চা নিয়ে তাঁর পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হতো না।
কাশফিয়া বেগম জানালেন, কয়েক মাস ধরে তাঁর স্বামীর কিছু শারীরিক সমস্যা হচ্ছিল। ট্রেনের মধ্যে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। গ্যাসের ওষুধ খান। মাথা ও মুখে পানি দেন। কিন্তু অচেতন হয়ে পড়ছিলেন। তারপর তো চিকিৎসক এলেন।
কাশফিয়া বেগম জানালেন, আজ তাঁর স্বামীর মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে রাখা হয়েছে। তবে তিনি কথা বলতে পারছেন। আগের চেয়ে ভালো আছেন। বুধবার তাঁকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন।
চিকিৎসক আহসান হাবিব উজিরের জন্ম টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। ২০১৮ সালে তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পে মেডিকেল অফিসার হিসেবে দুই বছর কাজ করেছেন। ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর ৪০তম বিসিএসে স্বাস্থ্য ক্যাডারে সিরাজগঞ্জে চৌহালী উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগ দেন। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (এমএস অপথালমোলজির ফেজ-এ রেসিডেন্ট) প্রেষণে আছেন। জানালেন, চক্ষু চিকিৎসক হিসেবে সুনাম অর্জন করতে চান। ভ্রমণের নেশা থাকায় দেশের ৬৪ জেলা ভ্রমণ করেছেন তিনি।
আহসান হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘ট্রেনে ওই রোগীকে যে অবস্থায় চিকিৎসা দিতে হয়েছে, রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে আমি জনরোষে পড়তাম বা এ ঝুঁকি ছিল। কিন্তু তখন ঝুঁকির কথা চিন্তা করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। সবার আগে মনে হয়েছে, যে করেই হোক রোগীকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে। ঝুঁকি নিয়েই কাজটি করেছি। চিকিৎসা দেওয়ার সরঞ্জামও হাতের কাছে ছিল না। সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া যে রোগী ভালো আছেন।’
আহসান হাবিব বলেন, ট্রেন এখন ভ্রমণের জন্য জনপ্রিয়। দূরপাল্লার যাত্রায় যে কেউ যেকোনো সময় অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন। এর আগে ট্রেনে বেশ কয়েকজন নারী সন্তানের জন্মও দিয়েছেন। তাই ট্রেনে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ফার্স্ট এইড বাক্সসহ জীবন বাঁচানোর মতো নাইট্রোগ্লিসারিন স্প্রে, নিডোকার্ড, ক্লপিডোগ্রেল, অ্যাসপিরিন—এমন কিছু ওষুধ রাখতে হবে। তবে এগুলো থাকলেই হবে না, সার্বক্ষণিক একজন চিকিৎসক, ট্রেনে খাওয়ার ঘরের মতো আলাদা একটি কক্ষ থাকা জরুরি। ট্রেনে চিকিৎসক রাখা সম্ভব না হলেও স্টেশনগুলোতে ব্যবস্থা রাখা জরুরি।